হিজাবধারী শিক্ষার্থীদের কলেজে ঢোকা নিষিদ্ধ। ক্লাস করা ও পরীক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ। হ্যাঁ আম্বেদকার প্রণীত সংবিধানের শপথ নেওয়া সরকারের পরিচালিত একটি সরকারী স্কুলে এমনই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। হিজাবধারী শিক্ষার্থীরা অবশ্য হাইকোর্টে আবেদন করেছে। হিজাব পরে কলেজে ঢোকার এবং ক্লাস করা ও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্যে। আমাদের আলোচনা হিজাব পরার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত কিনা। কিংবা সেই হিজাব পরতে না দেওয়ার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত কিনা। সেই বিষয়ে নয়। কারণ, এর উত্তর যেকোন ভারতীয় নাগরিকের কাছেই রয়েছে। এবং আদালত তার বিচার করবে। আমরা বরং এই হিজাব নিয়ে শুরু হওয়া রাজনীতির দিকেই দৃকপাত করি। সামনেই উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। ডিসেম্বরেই হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত হিন্দু সংসদের মঞ্চ থেকে ভারতবর্ষে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শপথ নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বিধর্মী ইসলামকে দেশ ছাড়া করার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার অঙ্গীকার সহ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি ঘোষণা দিয়ে রেখেছে এই নির্বাচন আশি বনাম কুড়ির লড়াই। উত্তরপ্রদেশ জুড়ে প্রচার চলছে এই নির্বাচনে বর্তমান শাসকদলের পরাজয় মানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা আবারো ফিরে আসার অশনিসংকেত। ঠিক এরই ভিতরে সুদূর ব্যাঙ্গালোরের একটি কলেজে হিজাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নির্বাচনী গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নাই কোন।
বিষয়টি যদি শুধুমাত্র হিজাব পরে কলেজে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকতো। তবু তার এক রকম অভিঘাত হতো। উল্টে, গলায় গেরুয়া ওড়ানা ঝুলিয়ে মুখে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে সেই কলেজেরই এক দল শিক্ষার্থী হিজাবের বিরুদ্ধে পথে নেমে প্রতিবাদ সংঘটিত করায় বিষয়টির অভিঘাত অনেক বেশি ব্যাপক এবং সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে। সরকারী কলেজই হোক আর বেসরকারী কলেজ। হিজাব পরে ঢোকা নিষিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু একই সাথে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে ইউনিফর্মের মতো করে একদল শিক্ষার্থী গেরুয়া রঙের ওড়না পরে মিছিল করে কলেজে প্রবশে করছে। বিষয়টি হঠাৎ করে ঘটতে পারে না। অনেক দিনের সংগঠিত পরিকল্পনা ছাড়া এমন ঘটনা ঘটার কথাও নয়। বিশেষ করে সামনে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের প্রাক্কালে। এই যে আশি বনাম কুড়ির লড়াই। সেই লড়াইকে উত্তরপ্রদেশের আসন্ন নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ না রেখে ভারত জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা। এর লক্ষ্য ও অভিমুখ একটা স্পষ্ট বার্তা বহন করছে।
আদালতের রায়ে হিজাব পরার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ফিরে পেলেও। এই ঘটনার জের কিন্তু এইখানেই শেষ হয়ে যাবে না। হিজাব পরতে না দেওয়া এবং উল্টে জয়শ্রীরাম ধ্বনী দিয়ে কলেজে প্রবেশ। ইউনিফর্মের মতো করে গেড়ুয়া ওড়ানা গলায় ঝোলানো। এই হলো সেই আশি বনাম কুড়ির লড়াই। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এর প্রতিবাদে সারা ভারত জুড়ে শুরু হওয়া গণ আন্দোলনকে কটাক্ষ করে যেদিন পোশাক দেখে মানুষ চেনার ফর্মুলা বাতলে দেওয়া হয়েছিল। অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক। সেইদিন থেকেই এই আশি বনাম কুড়ির লড়াইয়ে গোটা ভারতবর্ষকে বেঁধে ফেলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ যার সলতে পাকানোর পর্ব ছিল।
তাই বলে পোশাক দেখে মানুষ চেনার বিষয়টি থেকে আশির পক্ষকে মুক্ত করে রাখার কোন পরিকল্পনাই নেওয়া হয়নি। উল্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ এই পক্ষকেও পোশাকের রঙে চেনানোর একটি অন্তঃসলিল প্রক্রিয়া যে শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্গালোরের কলেজটিতে ইউনিফর্মের মতো করে গেরুয়া ওড়না গলায় ঝুলিয়ে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে শিক্ষার্থীদের এক অংশের মিছিল করে কলেজে প্রবেশ সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। এই সত্যটুকু অস্বীকার করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকার সময় এখন নয়। হয় এই সত্যের পক্ষ নিতে হবে। ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে অস্বীকার করে। আর নয়তো ভারতীয় সংবিধানের সেই মৌলিক কাঠামোকেই সুরক্ষিত করতে এই সত্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হবে। গর্জে উঠতে হবে আশি বনাম কুড়ির ঘোষিত লড়াইয়ের বিরুদ্ধেও।
উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনেই যে এই বিষয়ের সমাধান হয়ে যাবে। তাও নয়। ভারতবর্ষকে একবার যখন আশি বনাম কুড়ির লড়াইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরাসরি। তখন সেই লড়াই কিন্তু সহজে থামতে দেওয়া হবে না। কোনভাবেই। সাম্প্রদায়িক ধোঁয়ার আড়ালে যতক্ষণ না অব্দি গোটা দেশের সম্পূর্ণ দখল নেওয়া সম্পন্ন হচ্ছে। ততক্ষণ। এই লড়াইয়ে হাওয়া দেওয়া চলতেই থাকবে। আদালতের রায়ই যে শেষকথা। তেমনটি বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। কোন রাষ্ট্রকেই কোন আদালত রক্ষা করতে পারে না। যদি না রাষ্ট্রের নাগরিক সেই রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। আর সেটিই শেষ প্রশ্ন। আমরা কি ভারতবর্ষের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে সক্ষম হবো? আমরা কি সত্যিই সেটি চাইবো? চাইছি আজকেও?
৭ই ফেব্রুয়ারী’ ২০২২