সকালের সংবাদপত্রের সংবাদে প্রকাশ, কলকাতার বিখ্যাত মানসিক হাসপাতাল ‘পাভলভ’ এর একতলায় নোংরা অন্ধকার দুটি ঘরে প্রায় জনা তেরো মহিলা আবাসিককে বন্দি করে রাখা হয়েছে। খবরে প্রকাশ। ঘর দুইটির অবস্থা বসবাসের অযোগ্য। আবাসিকদের দুইবেলা ঠিক মত আহারও জুটছে না। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ পরিস্কার করার ব্যবস্থা নাই। খাওয়ার পাত্র থেকে অন্যান্য ব্যবহার্য্য সামগ্রীর অবস্থাও স্বাস্থ্যকর নয়। ছড়ানো ছিটানো ভাঙা লোহার খাটেই আবাসিকদের শোয়ার ব্যবস্থা। প্রকাশিত খবর থেকে এটা পরিস্কার। আবাসিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকে শুরু করে তাদের থাকার জায়গা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার সকল ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়েছে। এবং চুড়ান্ত এক অস্বাস্থ্যকর অমানবিক পরিবেশ এবং পরিস্থিতির ভিতরে দিন কাটাতে হচ্ছে মানসিক ভারসাম্য হারানো অসহায় মানুষগুলিকে। যাঁদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সুচিকিৎসার পরিসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে। গোটা হাসপাতালের মাত্র দুটি ঘরের এই চিত্রই যে কোন মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্যের কারণ হতে পারে। গোটা হাসপাতালের সামগ্রিক পরিস্থিতির কোন খবর অবশ্য জানা যায়নি।
মানসিক জটিলতার শিকার হওয়া মানুষের জন্য যে বিশেষ পরিসেবার প্রয়োজন। যে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। যে বিশেষ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। সেইগুলির অভাব, মানসিক ভারসাম্যকে ফিরিয়ে আনার বদলে সেই ভারসাম্যকে চিরতের নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। এবং এই যদি একটি সরকারী হাসপাতালের চিত্র হয়। এই যদি বাঙালির সাংস্কৃতিক পীঠস্থান কলকাতার চিত্র হয়। তবে সারা রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তের ছবিটা খুব একটা অস্পষ্ট থাকে না। থাকার কথাও নয়। এখন প্রশ্ন হলো। এই পরিণতির দায়ভার কার? যে সকল চিকিৎসক মানসিক রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্বে। তাঁদের? যে সকল স্বাস্থ্যকর্মী মানসিক রোগীদের দুইবেলা দেখাশোনার দায়িত্বে। তাঁদের? যে সকল আধিকারিক পাভলভ হাসপাতালের ব্যবস্থপনার দায়িত্বে। তাঁদের? হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের যাঁরা আত্মীয়স্বজন। যাঁরা বাড়ির প্রিয়জনের মানসিক স্বাস্থ্যহানির কারণে পাভলভে নিয়ে এসে ভর্তি করে গিয়েছিলেন সুচিকিৎসার আশায়। তাঁদের? স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যে আধিকারিকরা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিসেবার বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাঁদের? সরকার গঠনকারী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিজয়ী রাজনৈতিক যে দল সমগ্র রাজ্যের অভিভাবক। তাঁদের? নাকি, যাঁদের ভোটে সরকার গঠন হয়। সেই আমজনতা? নাগরিক ভোটার? তাঁদের?
না, এই দায়ভার নেওয়ার দায় এবং দায়িত্ব সম্ভবত এই রাজ্যের কারুরই নেই। থাকলে। পাভলভ হাসপাতাল থেকে এই ধরণের অমানবিক একটি চিত্র উঠে আসতো না নিশ্চয়। এখন যে প্রশ্নটি সকলের আগে উঠে আসে। সেটি হলো এই। মানসিক রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে যাঁরা। মানসিক রোগীর সেবা ও পরিচর্চার দায়িত্বে যাঁরা। সরকারী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কেষ্ট এবং বিষ্টুরা। নির্বাচিত সরকার এবং নির্বাচক মণ্ডলী। যাঁদের ভোটে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সরকার গঠিত হয়। এই প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আদৌ সুস্থ্য তো? এই রাজ্যে সিবিআই তলব করলেই নেতা মন্ত্রীদের বুকে যে ব্যাথাটা ওঠে। যে ব্যাথার সরকারী ঠিকানা উডবার্ন ওয়ার্ড। এবং যে ব্যাথার উপশমে বাঘা বাঘা চিকিৎসদেরর বোর্ড গঠন করতে হয়। এই গোটা প্রক্রিয়াটুকু কতটা মানসিক ভারসাম্যের দিক নির্দেশ করে। প্রশ্নচিহ্ন সেখানেও। প্রশ্নচিহ্ন সেখানেও। যেখানে মানুষের জন্য নির্দিষ্ট ডায়লোসিস যন্ত্রে বিশেষ একজনের কুকুরের ডায়লোসিস করার সরকারী হুকুমনামাও জারি হয়ে যায়। প্রশ্নচিহ্ন সেখানেও। যেখানে রাজ্যজুড়ে এইসব ঘটনাও রাজ্যবাসীর দিবানিদ্রায় কোনরকম ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না।
কোথায় কোন পাভলভ হাসপাতাল। তার কোন তলায় কোন ঘরে কি অবস্থায় দিন কাটছে জনা কয়েক সহ নাগরিকের। তাতে রাজ্যবাসীর কি এসে যায়? এই যে এক মানসিক স্থিতি। আমাদের প্রশ্ন। এই মানসিক স্থিতি’র ভারসাম্য নিয়েই। শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান শিল্প বাণিজ্য রাজনীতি সমাজ শিল্পকলা সংস্কৃতি। এই সবকিছুই কিন্তু এই মানসিক স্থিতিরই অধীনস্ত। যে মানসিক স্থিতিতে পাভলভ হাসপাতালের দুটি ঘরের এই রকম এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সেই মানসিক স্থিতির ভারসাম্য নিয়ে আজও যদি কোন প্রশ্ন না ওঠে। সমাজের ভিতর থেকে। তখন অসুখের বিস্তার সমগ্র জাতির মর্মমূলে পরিব্যাপ্ত হতেই থাকবে। কোথায় কোন এক পাভলভ হাসপাতালের কোন তলায় কয়জন মানসিক ভারসাম্যহীন সহনাগরিক কি অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। সেই খবরে তখন কারুরই কিছু এসে যাওয়ার কথা নয়। এসে যায়ও না। আর এখানেই প্রশ্নচিহ্ন আমাদের প্রত্যেকের মানসিক স্থিতি ও তার ভারসাম্য নিয়ে।
১৯শে জুন।
কপিরাইট সংরক্ষিত