শিক্ষার্থীদের দাবি। অনলাইন পরীক্ষা নিতে হবে। পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে তারা পরীক্ষা দিতে রাজি নয়। কারণ একটি রয়েছে। মাত্র যে কয়দিন শিক্ষাকেন্দ্রে ক্লাস নেওয়া হয়েছে। তাতে সিলেবাস শেষ করা যায়নি। ফলে বাড়িতে বসে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। অতিমারীর সুযোগে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধে কি। সেটি টের পেয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো সুবিধে সিলেবাস শেষ না হলেও দিব্যি পরীক্ষা দেওয়া যায়! মজার কথা শিক্ষার্থীরা আগে সিলেবাস শেষ করার দাবি জানাচ্ছে না। তারা বিদ্যাচর্চার দাবিও জানাচ্ছে না। আর ভয়ের বিষয়। ঘরে ঘরে অভিভাবক অভিভাবিকারাও শিক্ষার্থীদের, অনলাইনে পরীক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার এই দাবির প্রতি সহমত পোষণ করছেন। এই যে একটি সামাজিক চিত্র। এই বাংলায় দেখা যাচ্ছে। এই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। আশা করাই যায়। ঘরে ঘরে তাদের অভিভাবক অভিভাবিকারাও যথেষ্ঠ পরিমাণে শিক্ষিত। ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চশিক্ষিত। কথায় বলে একটি ভাত টিপলেই গোটা হাঁড়ির খবর পাওয়া যায়। ফলে অনলাইনে পরীক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার এই দাবি তোলার ভিতর দিয়েই আমাদের বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করে নেওয়া যায়।
বহু দশক ধরেই শিক্ষিত হয়ে ওঠা বলতে আমরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী লাভকে বুঝে থাকি। আর সেই ডিগ্রী হাসিল করার একটিই পথ। পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তি। কিংবা ভালো নম্বর পাওয়া। যে নম্বরের ভিত্তিতে একটা সম্মানজনক ডিগ্রী লাভ সম্ভব হয়। যদিও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ডিগ্রী’র এমনিতে বিশেষ কোন ভুমিকা নেই। অন্তত মেধার বিকাশের ক্ষেত্রে। অবশ্য মেধার বিকাশ ঘটানো সাধারণত শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক অভিভাবিকাদের অভীষ্ট লক্ষ্যও নয়। এই ডিগ্রীর একমাত্র ভুমিকা একটি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। ফলে চাকরি পাওয়াটাই যেখানে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। সেখানে যেভাবেই হোক একটি ডিগ্রী আমাদের বাগিয়ে নিতেই হবে। না, সকলেই যে অস্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী বাগিয়ে নেওয়ার মতো বিদ্যে ধরেন তা নয়। ফলে প্রায় সকলকেই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডিগ্রীর উপরেই ভরসা করতে হয়। এখন এই ডিগ্রী পেতে গেলে। যেহেতু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াই একমাত্র উপায়। সেই কারণে শিক্ষার্থী থেকে অভিভাবক অভিভাবিকাদের মূল লক্ষ্যই থাকে যেভাবেই হোক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নেওয়া পরীক্ষায় বেশি বেশি করে নম্বর তোলা। এখন এই বেশি বেশি নম্বর পাওয়ার উপায় কি কি? একটি উপায় পরীক্ষা হলে টুকে পরীক্ষা দেওয়া। না, বুদ্ধিমানেরা এবং পরিশ্রমীরা সেই পথে এগোয় না। কারণ টুকে পরীক্ষা দিলে পাশ করা যেতে পারে। ভালো এবং বেশি বেশি করে নম্বর পাওয়া সহজ নয়। ভালো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায়। ফলে অধিকাংশ ঘরেই অভিভাবক অভিভাবিকারা সন্তানদের মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার প্রাণপাত চেষ্টা করেন। যাতে পরীক্ষায় অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তরই শিক্ষার্থীরা মুখস্থশক্তির বলে লিখে আসতে পারে। বেশি বেশি নম্বর পাওয়ার এই এক ভদ্রস্থ উপায়। উপায়টি বেআইনীও নয়। রীতিমত পরিশ্রম সাপেক্ষ। ফলে আমাদের দেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল করে বেড়িয়ে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই এই পরিশ্রমী মুখস্থবিদ। এই কারণেই এই মুখস্থবিদরাই সমাজে মেধাবী বলে পরিচিত এবং সম্মানিত। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রতিবছর এক ঝাঁক করে এমন মুখস্থবিদ তৈরী করে নেয়। যারা আমাদের দেশ ও সমাজকে পরবর্তীতে চালিয়ে নিয়ে যায়।
এই যে এক অভিনব শিক্ষাব্যবস্থা। সেই ব্রিটিশের আমলে পত্তন করা। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চা এবং জ্ঞানচর্চার কোন স্থান নেই। শুধুমাত্র একটি ভালো চাকরি পাওয়ার উপায় হিসাবেই এই শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব। এবং সেই গুরুত্বের কারণেই অভিনব এই ব্যবস্থাটি টিকে রয়েছে কয়েক শতক ধরে। ঘরে ঘরে অভিভাবক এবং অভিভাবিকারা তাই সন্তানদের এই শিক্ষাব্যবস্থার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। একেবারে প্রাইমারি স্তর থেকে। যে কারণে শিক্ষার্থী মানেই জানে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াটাই শিক্ষিত হয়ে ওঠার একমাত্র পথ। এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমারীর কারণে সিলেবাস শেষ না হওয়ায়, তারা বুঝতে পেরেছে। শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিলে ঐ ভালো এবং বেশি নম্বর পাওয়া সম্ভব হবে না। তার থেকে বাড়িতে বসে অনলাইনে পরীক্ষা দিলে গুছিয়ে উত্তরপত্র সাজিয়ে তোলা সম্ভব হবে। বেশি বেশি করে নম্বর তোলার জন্য যা একান্ত জরুরী। আর এই নম্বরের উপরেই নির্ভর করছে কে কত দামি ডিগ্রী অর্জন করতে পারবে। যে সার্টিফিকেটটি না থাকলে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নামাই যাবে না। ফলে অন্নসংস্থানের জন্য জরুরী যে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। সেই কর্মসংস্থানের উদ্দেশেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলিতে বেশি বেশি করে নম্বর তোলাটাই শিক্ষার্থীদের এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে সবচেয়ে বেশি জরুরী বিষয়।
এখন অফলাইনে পরীক্ষা দিলে যদি সেই মূল বিষয়টিই সুনিশ্চিত করা না যায়। সেই কারণেই শিক্ষার্থীরা আজ ধর্ণায়। অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হবে। সিলেবাস শেষ না হলেও চলবে। বিদ্যাশিক্ষা অসমাপ্ত রয়ে গেলেও কোন ক্ষতি নেই। দরকার শুধু বেশি করে নম্বর তুলে একটা ভালো ডিগ্রীর সার্টিফিকেট হাসিল করা। শিক্ষার্থীদের এই বোধের শরিক ঘরে ঘরে অভিভাবক থেকে অভিভাবিকারাও। এটাই বাংলার সমাজ বাস্তবতা। এটাই বাঙালির শিক্ষাব্যবস্থার আসল স্বরূপ। এটাই বাংলার অভিভাবক অভিভাবিকাদের অভীষ্ট। যে লক্ষ্যে তারা আপন সন্তানদেরকেই বলির পাঁঠা করে ছাড়েন।
২৪শে মে’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত