রাজ্যজুড়ে ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের ভুমিকা কি? এই বিষয়ে কোন আলোচনা শোনা যায় কি? পুলিশের কাজ কি? ধর্ষককে বিচারের ন্যায়দণ্ডের সামনে হাজির করানো। দেশে একটা সংবিধান রয়েছে। তার উপরে ভিত্তি করে আইনের নানান ধারা ও উপধারা রয়েছে। ধর্ষণের শাস্তির জন্য নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। ধর্ষণের কাণ্ডে যুক্ত অপরাধী এবং অভিযুক্তদের খুঁজে পেতে এবং গ্রেফতার করতে দেশজুড়ে পুলিশ রয়েছে। আমাদের রাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ভুমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণের কাণ্ড ঘটে গেলে। সেই ঘটনার সঠিক এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করা ও আদালত গ্রাহ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে আদালতের সামনে পেশ করা। এইসবই পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ভিতরে পড়ে। পুলিশের কাজ যদি যথাযোগ্য হয়। তাহলে অধিকাংশ ধর্ষকেরই সঠিক বিচার হওয়ার কথা। বিচারের আইন নির্দিষ্ট। সেই আইনের চোখে সঠিক প্রমাণ হাজির করতে পারলেই সঠিক বিচারের একটা আশা থাকে। আশা থাকে বলার কারণ রয়েছে। বিচার ব্যবস্থা সঠিক ভাবে আইনের ব্যবহার করে ধর্ষণ কাণ্ডের অপরাধীদের যথাযোগ্য শাস্তি বিধান করবে কি, করবে না। সেটি বিচারকের উপরেও নির্ভরশীল। বিচারক যদি ন্যায়পরায়ণ এবং সৎ হন। তাহলে, পুলিশ ধর্ষণ কাণ্ডের সঠিক প্রমাণ আদালতের কাছে পেশ করতে পারলে। ধর্ষকের যথাযোগ্য শাস্তি না হওয়ার কোন কারণ নেই। এই বিষয়ে ধর্ষকের পক্ষে যত বড়ো অভিজ্ঞ উকিলই থাকুক না কেন। আদালতে পুলিশের পেশ করা প্রমাণই কিন্তু শেষ কথা। অন্তত তেমনটাই তো হওয়া উচিত।
হওয়া যেটা উচিত। সেটি সকলেই জানে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে যেটা হয়। সেটি কোন দেশ বা জাতির পক্ষেই সম্মানের কথা নয়। আমাদের ভিতরে সেই বিষয়ে কোন বিতর্ক থাকার কথাও নয়। ফলে আইনের সঠিক প্রয়োগ যদি না হয়। আক্রান্ত মহিলা যদি ন্যায় বিচার না পান। তবে দায় কার? দায় কিন্তু পুলিশ প্রশাসন এবং আদালতের। অর্থাৎ রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিককে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। তবে সেই ব্যর্থতা কোথায় কিভাবে ঘটছে। বা ঘটে থাকে। রাষ্ট্রকেই তার হদিশ নিতে হবে। এবং জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। এও সেই যা হওয়া উচিত। তার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজ জীবনে ঘটছে ঠিক তার উল্টো ঘটনা। দুই একটি ব্যাতিক্রমী ঘটনা বাদ দিলে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাই নানান ভাবে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। ধামাচাপা দেওয়া না হলেও। ধর্ষণের মামলাকে বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর আদালতের জামিন পেয়ে অভিযুক্ত অপরাধী যাবতীয় প্রমাণ লোপাটে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। এটাই আমাদের দেশ।
ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে। বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে। পুলিশের প্রকৃত ভুমিকা হলো শাসক দলের স্বার্থ রক্ষা করে আইনের ব্যবহার করা। ফলে ধর্ষণকাণ্ডে শাসকদলের কারুর নাম জড়িয়ে গেলে পুলিশের পক্ষে আর কিছুই করার থাকে না। গোটা ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া ছাড়া। ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে না পারলে। পুলিশের পরবর্তী দায়িত্ব দাঁড়ায় প্রমাণ লোপাটের। ধর্ষণের মতো ঘটনায়। শাসকদলের কারুর নাম জড়িয়ে না থাকলেই যে পুলিশ তার দায়িত্ব যথাযোগ্য ভাবে পালন করে থাকে। তেমনটাও নয়। ধর্ষণের কাণ্ডে জড়িতরা অনেক সময়েই প্রভুত অর্থের বিনিময়ে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে সক্ষম হয়। তারপর রয়েছে আদালত। সেখানেও অর্থের একটা বড়ো ভুমিকা থাকে। থাকে সাক্ষীদের ভয় দেখিয়ে মামলা দুর্বল করে দেওয়ার ঘটনা। এইসবের বাইরে ঘটা ধর্ষণের ক্ষেত্রেই সাধারণত ভিক্টিম ন্যায় বিচার পেয়ে থাকে। যেখানে ধর্ষণের কাণ্ডে জড়িতরা শাসকদলের কেউ নয়। কিংবা কোনরকম রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগহীন। অর্থের জোর নেই। বা তদন্তকারী পুলিস আধিকারিক সৎ এবং দায়িত্ববান। ধর্ষিতার পক্ষে দক্ষ উকিল জোগার করার মতো আর্থিক সঙ্গতি বিদ্যমান। সাধারণত এই এতসব শর্ত পুরণ হলে তবেই ধর্ষণকাণ্ডের ভিক্টিমের পক্ষে ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব। আমাদের দেশে।
অবশ্যই কোন সমাজের পক্ষেই এই চিত্র সম্মানের নয়। নিরাপদের নয়। ধর্ষণকাণ্ড যতই একটি ঘৃণ্য অপরাধ হোক না কেন। ধর্ষক মাত্রেই জানে। রাজনৈতিক দল যদি পাশে থাকে। আর শাসকদল হলে তো কোন কথাই নেই। মনের সুখে ধর্ষণ করেও নিশ্চিন্তে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে। খুব বেশি কিছু হলে। মিডিয়ার শিরোনামে এসে গেলে। প্রাথমিক ভাবে কয়দিন হাজতবাস। তারপর আদালতের জামিন নিয়ে ধর্ষিতার নাকের ডগায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে। একটু যারা সাবধানী মার্কা ধর্ষক। তারা অবশ্য অতটাও ঝুঁকির ভিতরে যেতে রাজি নয়। ধর্ষণের পর ধর্ষিতার গায়ে আগুন লাগিয়ে দাও পুড়িয়ে। সব প্রমাণ লোপাট। আগুন লাগানোর সুবিধেও যে সব সময়ে পাওয়া যাবে তেমনটাও নয় অবশ্য। আগুনের শিখায় ধরা পড়ে যাওয়ারও ঝুঁকি থাকতে পারে। স্থান কাল পাত্র বুঝে। তাই শ্বাসরোধ করে বা অন্য কোন উপায়ে ধর্ষিতার প্রাণ কেড়ে নিলেই ঝামেলা মিটে যায়। এইসব ক্ষেত্রেই পুলিশের কাজও অনেকটা সহজ হয়ে যায়। প্রমাণ না থাকলে আর ঝামেলা কি? যত ঝামেলা তো প্রমাণ লোপাট করে ঘটনা ধামাচাপা দিতেই। বিশেষ করে ধর্ষণকাণ্ডে শাসকদলের কারুর নাম জড়িয়ে গেলেই পুলিশের হয় মহা বিপদ। খাটুনি যায় কয়েকগুন বেড়ে। কিন্তু করারও তো কিছু থাকে না। শাসকদলের কেউকেটাদেরকে তো আর বিচারের বাণী শোনানোর জন্য আদালতে নিয়ে যাওয়া যায় না। চাকরি নিয়ে টানাটানি। ফলে পুলিশের তখন মূল কাজই হলো প্রমাণ লোপাট। এবং মামলা দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করা।
এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় নির্বাচনী শাসনতন্ত্রে পুলিশের পরিণতি। যখন যে দল শাসন ক্ষমতায় নির্বাচিত হবে। পুলিশকে তখন সেই দলের হয়ে কাজ করতে হবে। তার জন্য যতরকম ভাবেই হোক না কেন। আইনকে বেঁকিয়ে শাসকদলের মুখ রক্ষা করতেই হবে। শাসকদলের মুখরক্ষাই পুলিশের যাবতীয় দায় ও দায়িত্ব, কাজ ও কর্তব্যের প্রাথমিক শর্ত। এটাই আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক শাসন সংস্কৃতি। ফলে অন্যান্য সব অপরাধের মতো ধর্ষণের বহরও দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। এই রোগ থেকে দেশের কন্যাদের নিরাপত্তা দিতে গেলে। পুলিশকে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণের থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশে সেটি করতে গেলে সকল রাজনৈতিক দলকে এই একটি বিষয়ে এক হয়ে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনী এনে। কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলই সেই কাজে আগ্রহী নয়। পুলিশকে দলীয় স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ কোন রাজনৈতিক দলই কোনদিন ছাড়তে চাইবে না। সকলেরই লক্ষ্য একটাই। শাসন ক্ষমতায় গিয়ে পৌঁছানো। এবং পূর্ববর্তী শাসকদলের ভোগ করে যাওয়া সব নৈতিক এবং অনৈতিক সুযোগ এবং সুবিধে ভোগ করা। ফলে পুলিশের দশা আসলেই চক্রব্যূহে ঢুকে পড়া অভিমন্যুর মতোন। এর থেকে নিষ্কৃতির কোন পথ আর নেই পুলিশের। আমাদের দেশে।
১২ই এপ্রিল’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত