তাঁকে ফোন করে কোন লাভ নেই। না, তিনি কোন ব্যাপারেই কোন কথা বলবেন না। শুধু মাত্র কাফি রাগ ছাড়া। এবং সম্পূ্র্ণ ফ্রী’তে তিনি এক কলি কাফি রাগ শুনিয়েও দিলেন। সাংবাধিক যখন রামপুরহাট গণহত্যার বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া নিতে চান। আমরা কেউই যদিও নিরোর সেই বেহালাবাদন শুনিনি। ঠিক যেদিন রোম পুড়ছিলো দাউ দাউ আগুনে। কিন্তু আমরা খুবই সৌভাগ্যবান। আমরা নিরোর সেই ভুবন বিখ্যাত বেহালাবাদন শুনতে না পেলেও। আমরা তাঁর কণ্ঠে কাফি রাগের এক কলি অনন্ত শুনতে পেলাম। বিশেষ করে এই আগুনে পোড়া সময়ে। দাউ দাউ আগুনে পশ্চিমবঙ্গও পুড়ছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। তিনি ও তাঁর মতো বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এই সময়ে শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চায় মজে রয়েছেন। এটা বাঙালির সৌভাগ্য যে গণহত্যার আগুন পোড়া ছাইয়ের গন্ধ তাঁদের কাছে গিয়ে পৌঁছায় না আর। কারণ বসন্ত আসুক না আসুক। পরিবর্তন এসে গিয়েছে। আর কোন চিন্তা নেই। যাঁর হাতে রঙ তুলি। তিনি ক্যানভাসে বসন্ত আনবেন। যাঁর হাতে সোনালি নিবের কলম। তিনি উপন্যাসে বসন্ত আনবেন। যাঁর কন্ঠে সপ্তসুরের সাগর। তিনি কাফি রাগে বসন্ত আনবেন। আর যাঁরা কবিতা পাঠে ব্যস্ত। কবিসম্মেলন থেকে শুরু করে সরকারী বেসরকারী কবিতা উৎসবে। তাঁদের কন্ঠের জাদুতে আর ছন্দের কারুকাজে বসন্ত এসে যাবে। চিন্তা কি।
খবরের কাগজে অগ্নিদগ্ধ পোড়া কান্নার শেষ আর্তস্বর শোনা যায় না। গেলেও অসুবিধে ছিল না। আমরা এখন এসবে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। এমন কথা বললেও আবার অসুবিধে রয়েছে। বহুজনেই হই হই করে উঠবেন। সাঁইবাড়ি থেকে বিজন সেতু। মরিঝাপ্পি থেকে নানুর। তাপসী মালিক থেকে নন্দীগ্রাম। স্মরণ করিয়ে দেবেন। দেওয়াই উচিত। কিন্তু কেউই উত্তর দেবেন না। যদি প্রশ্ন করা হয়। তাহলে পরিবর্তনটা আর হলো কোথায়? না, সেই ছোটবেলার ক্লাসে। শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকার বকুনি খেলেই। আমরাও কিন্তু এই একই কথা তুলতাম। ও’তো একই কাজ করেছে বলে। শুধুই তো আমি নই। ঠিকই। শুধুই তো এখনই নয়। কাশীপুর বরাহনগরের সেই গণহত্যা। তার আগে পরে। জেল থেকে বন্দী নকশালদের ছেড়ে দিয়ে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা। আবার শ্রেণীশত্রু খতমের নামে গুপ্ত হত্যা। স্মরণ করতে শুরু করলে লিস্ট ক্রমেই লম্বা হতে থাকবে। না, নির্বাচনী লড়াইয়ে বুথে বুথে ক্ষমতা দখলের চর্চায় বোমাবাজি গুলিবাজি। এই হিসেবের বাইরে। ওটা গণতন্ত্রের কালচার। নির্বাচন আসবে। আর লাশ পড়বে না। সোনার পাথরবাটি আর কি! পশ্চিমবঙ্গের এটাই সংস্কৃতি। এটাই ঐতিহ্য। এটাই উত্তরাধিকার।
পরিবর্তনের স্বর্গরাজ্যে নতুন এক সংস্কৃতির আমদানি হয়েছে। বখরা নিয়ে রাজনৈতিক তরজা। অন ক্যামেরা নিহত নেতার সদ্য বিধবা পত্নীকে স্বামী হারানোর শোকে হাহাকার করতে শোনা যাচ্ছে, ‘ও তো শুধুই একা খেত না। সবাইকেই খাওয়াতো’ বলে। তবে কেন তাকে হত্যা করা হলো। প্রশ্নটা এইখানেই। সদ্য স্বামী হারানো একজন অসহায় গৃহবধুর। না, মৃত নেতার ভক্তবৃন্দ সেই উত্তর খোঁজার জন্য অপেক্ষা করেনি। একের পর একজনকে কুপিয়ে গায়ে অগ্নিসংযোগ করে ঘরে তালা দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে প্রতিশোধের আগুন নিভিয়েছে। শিশু মহিলা সহ দশজনের অগ্নিদগ্ধ পোড়া দেহের গন্ধ হয়তো সকলের কাছে গিয়ে পৌঁছাতে পারে না। তাই তাঁদের ভিতরে কেউ যদি সেই সময়ে সচ্ছন্দে কাফি রাগের তানে আমাদের বিমোহিত করতে পারেন। সে বঙ্গবাসী হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য বইকি। তিনি অন্য কোন ব্যাপারে কথা বলবেন না। অবশ্যই না বলতে পারেন। সেটি তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতা। তিনি গণহত্যার প্রতিক্রিয়া হোক আর না হোক, কাফি রাগের তান শোনাবেন সাংবাদিককে। সেটি তাঁর মতপ্রকাশের অধিকারের বিষয়। সেই বিষয়ে আমাদেরও কিছু বলার নেই। তবে এটা আমাদের বুঝে নেওয়ার সময়। এটা আমাদের শিক্ষা নেওয়ার সময়। সেই বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের দিনগুলির মতো। শেখার কোন শেষ নেই। শিক্ষার কোন বয়স নেই। বসন্ত আসুক না আসুক। পরিবর্তন এসে গিয়েছে।
সত্যিই পরিবর্তন এসে গিয়েছে। ক্ষমতায় থাকা শাসকের গুডবুকে থাকতে হবে। না থাকলে প্রধান বিরোধী দলের গুডবুকে থাকতে হবে। তাতে গরুর দুধে সোনা থাকা’র গল্পে অবিশ্বাস করলে চলবে না। দুই শিবিরের এক শিবিরের খুটিতে নিজেকে বেঁধে রাখতেই হবে। আর যে গোয়ালের যে নিয়ম। গরু মাত্রেই জানে। সেই নিয়মে খুঁটিতে বাঁধা দঁড়ির শাসনে ওঠবোস করার মন্ত্র মেনে চলার ভিতরেই আসল স্বাধীনতা। না, সেই স্বাধীনতা হারাতে কে আর চায়? ফলে যাঁর হাতে যা আছে। রঙতুলি। কলম। কিংবা যাঁর গলায় যা কিছু জাদু! সুর থেকে স্বর! সব নিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে লাইনে দাঁড়াতে হবে। কপাল খারাপ থাকলেও অসুবিধে নেই। প্রধান বিরোধী দলের দরজাও সকলের জন্যেই খোলা রয়েছে। দরজা শুধুই শাসক শিবিরেরই খোলা থাকে না। যত বড়ো বুদ্ধিজীবী। তার তত বেশি কদর। দুধেলা গাইয়ে’র কদর গোয়ালা মাত্রেই করে থাকে। শাসক থেকে বিরোধী।
গণহত্যার আগুনে কতজনের দগ্ধাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। তাই নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর কতটা লাভবান হলো। শাসক শিবিরের পেশী কতটা ফুলে উঠলো। রাজ্যবাসী শাসকের ভয়ে আরও কতটা প্রকম্পিত হতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠার শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হলো। এসব কোন কিছুই বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা। কাফি রাগ শোনা ও শোনানোর টাইমিংটাই। টাইমিং ঠিক হলেই ব্যাটে বলে ছক্কা। আর এই টাইমিংয়ের হিসেবটা বাংলার বুদ্ধিজীবীরা সারা বিশ্বকেই শিখিয়ে দিতে পারে। শাসক আসবে যাবে। পরিবর্তনের পর পরিবর্তন হতে থাকবে। বুদ্ধিজীবীদের এই টাইমিং জ্ঞানে ভুল হবে না। আর যদিবা কারুর ভুলও হয়। শুধরে নেওয়ার অগাধ সময় রয়েছে। শুধু শুধরে নেওয়ার মানসিকতাটুকু থাকলেই হলো। কেউ আগে। কেউ পরে। কেউ হাওয়াই চটিতে। কেউ ছাপ্পান্ন ইঞ্চিতে। কেউই বাদ যাবেন না। আজ এ দল। কাল ও দল। আসা যাওয়ার পালা। সে তো চলতেই থাকবে। জনতাও রগড় দেখতে অভ্যস্থ। নতুন শুধু এই কাফি রাগের তানটুকু। এইটুকুই বাদ ছিল। সেটিও এই সুযোগে পাওয়া গেল। ফ্রী অফ কস্ট। গণহত্যার পোড়া গন্ধ নাকে এসে না পৌঁছলেই হলো।
২৪শে মার্চ’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত