মার্চ ৫’ ২০২২। ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের দশম দিন। মস্কো সময়ে সকাল দশটা থেকে ঘন্টা খানেকের যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছে মস্কো। অবরুদ্ধ শহরের জনগণ যাতে নিরাপদ অঞ্চলে রওনা দিতে পারে। এবং সাধারণ মানুষের কাছে যথা সম্ভব জরুরী পরিসেবা পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য। না, এই সংবাদ কোন রুশ সংবাদ সংস্থা থেকে নেওয়া নয়। কারণ, ছাপ্পান্নো ইঞ্চি ছাতির দোর্দণ্ড প্রতাপ ভারতবর্ষে, মার্কিন চোখরাঙানিতে আপাতত রুশিয়া টুডে টিভি চ্যানেলের সম্প্রসারণ বন্ধ। এই সম্প্রসারণ বন্ধ করা হয়েছে, রুশ সামরিক অভিযানের নবম দিন। ফলে প্রচারিত সংবাদের সত্যতা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। আরও একটি সংবাদ জানানোর প্রয়োজন এই মুহুর্তে। মার্কিন সেনেটর লিণ্ডসে গ্রাহামের করা সেই বিখ্যাত টুইট। পুতিন খুনের আহ্বান করে। টুইটার কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, এই টুইট তাদের টুইটারের নিয়ম ও নীতির কোন লঙ্ঘন করছে না। অর্থাৎ পুতিন হত্যার ফতোয়া দেওয়ার অধিকার একজন মার্কিন সেনেটরের যেমন রয়েছে। তেমনই সেই ফতোয়া বিশ্বজুড়ে প্রচার করার অধিকারও টুইটার কর্তৃপক্ষের রয়েছে। ঠিক যেমন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন আগেই ইউক্রেনের নব-নাৎসী সংগঠনের একাউন্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে। ফেসবুকের যুক্তি। নব-নাৎসীদেরও নিজেদের মত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। না, তাই বলে রুশিয়া টুডে টিভি চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের বাকি বিশ্বের কাছে সংবাদ পৌঁছিয়ে দেওয়ার কোন অধিকার নেই। যে অধিকার রয়েছে নব-নাৎসী গোষ্ঠীদেরও। এটাই বর্তমান বিশ্বের গণতন্ত্রের সংবিধান। মার্কিন-ন্যাটো শক্তি অক্ষের স্বার্থে সব কিছু পরিচালিত হবে। হতে থাকবে। সেই স্বার্থের বিরুদ্ধে আঙুল তুললেই মুশকিল। ধোপা নাপিত বন্ধ। বিশ্বজুড়ে খলনায়ক প্রতিপন্ন করে হত্যার ফতোয়া। ফলে দেখা যাচ্ছে ফতোয়া শুধুমাত্র মৌলবাদী তালিবানরাই দেয় না।
যুদ্ধের সময়ে প্রোপাগাণ্ডা মেশিনারী সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ যুদ্ধ করে মানুষের মতো হিংস্র প্রজাতির প্রাণীরাই। বাকি জীবজগতে লড়াই রয়েছে প্রতিদিনের। কিন্তু যুদ্ধ নেই। সেই যুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা চালানোর অধিকার কিন্তু কেবলমাত্র একটি পক্ষেরই। যে পক্ষ বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বেড়ায়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া। সবখানেই যুদ্ধটা কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যেই। তাই সেই যুদ্ধে কোটি কোটি মুসলিম মারা গেলে আনন্দ বই দুঃখ নেই। কিন্তু মুক্ত চিন্তা আর ফ্রী স্পিচের প্রবক্তাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করলেই নয়। ফলে প্রোপাগাণ্ডা চালানোর অধিকারও শুধুমাত্র সেই ফ্রী স্পিচ থিওরি’র প্রবক্তাদের একার। তাই বিশ্ব জুড়ে রাশিয়ার সকল সংবাদমাধ্যমকেই স্তব্ধ করে দিতে হবে। মানুষ না হলে বিবিসি সিএনএন ফক্স নিউজ আল জাজিরার পাঠশালায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে কি করে? বিশ্বজুড়ে এই মুহুর্তে একটিই হোমটাস্ক দেওয়া হয়েছে মানুষকে। সকাল সন্ধ্যা রাজপথে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ স্লোগানে গলার শিরা ফুলিয়ে তুলতে হবে। পুতিনের মুণ্ডপাত করে মিছিল চালিয়ে যেতে হবে। সেই হেমটাস্কের পরে আবার বাধ্য ছাত্রের মতো ওয়েস্টার্ন মিডিয়ার পাঠশালায় বসে যেতে হবে। নতুন নতুন প্রোপাগাণ্ডায় মগজ বোঝাই করে নিতে। ফ্রী স্পিচ আর গণতন্ত্রের এমন সুদিন আর কবে ছিল? ছিল বই কি? মার্কিন অপশক্তির আফগানিস্তান দখল, ইরাক দখল, লিবিয়া দখল। সেই সময়েও এই এক ভাবেই আমরা বিশ্বজুরে ফ্রী স্পিচের চর্চা করেছিলাম বইকি! না, তাই বলে তখন ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ স্লোগানে গলার শিরা ফুলিয়ে তোলার কোন গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। একটাই অধিকার ছিল। লাদেনের মুণ্ডু চাওয়া। সাদ্দামের মুণ্ডু চাওয়া। মৌলবাদ নিপাত যাক বলার অধিকার।
এখন, মৌলবাদের পরিসর কতটা বিস্তৃত। না, সেই বিষয়ে মাথা ঘামানোর অধিকার এই গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমাদের দেওয়া হয়নি কিন্তু। আমরা চাইও না। আসল কথা, মাথা ঘামানোর পরিশ্রমে আমরাও রাজি নই। টিভি খুলবো। নেট অন করে লগইন করবো। খবরের কাগজের পাতা ওল্টাবো। যা আমাদের বোঝানো হবে। আমরা বিনা প্রশ্নে তাই গিলতে থাকবো। গিলতে তো আমাদের হবেই। না হলে গণতন্ত্র বিপন্ন। ফ্রী স্পিচের পরিসর কমে আসতে থাকবে। আমরা নতুন নতুন কথা বলে ফেলতে পারি। মুখ ফস্কে। বিশ্বব্যবস্থার নিয়ামকদের গায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে যে তাহলে। আর ফোস্কার ভয় কিন্তু মারাত্মক। কে আর অমন মারাত্মক জ্বালা সহ্য করতে চায়? তাই মৌলবাদের প্রহরেই আমাদের জীবনযাপন চলছে চলবে। ফলে কখন আমরা যুদ্ধ চাই শান্তি নয় স্লোগান দেবো। আর কখন আমরা যুদ্ধ নয় শান্তি চাই স্লোগান দেবো। সেটা ঠিক করে দেবে মার্কিন-ন্যাটো-ইসরায়েল পক্ষ। তাই ১৯৯৪ সালে ন্যাটোর যুগস্লাভাকিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়, ইউরোপের মানুষ আজকের মতো পথে নেমে যুদ্ধ নয় শান্তি চাই বলার সাহস দেখাতে পারেনি। আজ যেমন বাধ্য ছাত্রের মতো রোজ নিয়ম করে রাজপথে যুদ্ধ বিরোধী প্যারেডে সামিল হচ্ছে। না হলেই বিপদ।
সেই বিপদটা কি। না, কারুরই অজানা নয়। কারুরই জানতে বাকি নাই। সকলেরই জীবনের মায়া থাকে। থাকবে। তাই প্যারেডে অংশ নেওয়ার ডাক এলে। নিতে হবে বইকি। যে খবর গেলানো হবে। গিলতে হবে বইকি। যার বিরুদ্ধে যাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হবে। খেপে উঠতে হবে বইকি। এটাই গণতন্ত্র। এটাই ফ্রী স্পিচের পরিসর। যেমন যেমন কথা শিখিয়ে দেওয়া হবে। তেমন তেমন কথা আউড়িয়ে যেতে হবে। ফলে অন্য কোন পক্ষের কথা শোনা বারণ। একেবারেই শোনা যাবে না। দেখা যাবে না। এমনকি ভাবাও যাবে না। যেমনটা দেখানো হবে। শোনানো হবে। ভাবানো হবে। দেখতে হবে। শুনতে হবে। এবং ভাবতে হবে্। ঠিক ততটুকুই। যতটুকু ভাবার অধিকার দেওয়া হবে। তার বেশি নয়। সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে সার্বিয়ানদের মতো রাশিয়ার সমর্থনে রাজপথ অধিকার করা চলবে না। বরং জর্জিয়ানদের মতোই ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে রাশিয়া বিরোধী স্লোগান দিতে হবে। এবং ভুলেও ইউক্রেন সমস্যার মূলে অনুসন্ধান করা চলবে না।
এর ভিতরেই খবর পাওয়া গেল। যুদ্ধ বিরতির সুযোগ নিয়ে মারিইউপোলের জনসাধারণের যারা শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে চাইছিলেন। শহরে অবস্থানরত নব-নাৎসী ও জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী তাদের পথরোধ করে আটকিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য পরিস্কার। রুশ বাহিনীর সামনে নিরাপরাধ জনতাকে দাঁড় করিয়ে রেখে শহরটিকে রুশ বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত রাখা। রাশিয়ানরা বারবার যে হিউম্যান-শিল্ডের কথা বলে আসছে। যে কারণে ইউক্রেনে সমারিক অভিযান প্রতিদিনই প্রলম্বিত হচ্ছে। অপর শহর সুমিতে আটকিয়ে পড়েছে ভারতীয় ছাত্ররা। যাদেরকে শহর ছেড়ে যেতেও দেওয়া হচ্ছে না। যাওয়ার পরিসর সৃষ্টির জন্যেই রুশ বাহিনীর সাময়িক যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা ছিল আজকে। শোনা যাচ্ছে সুমি শহরে পাঁচজন ভারতীয় ছাত্র আহত। দশ এগারো জনের কোন হদিশ নেই। বাকিরা এখনো আটকিয়ে। ভারতী ছাত্রদের বিশেষ করে আটকিয়ে দেওয়ার কারণ খুবই স্পষ্ট। ভারত এখনো সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। তাই ভারতীয় ছাত্রদের আটকিয়ে দিলে, ভারত জুড়ে রাশিয়া বিরোধী জনচেতনা জাগিয়ে তোলা সহজ হবে। ভারতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য করার কাজটাও সহজ হয়ে উঠবে।
শেষ খবর পাওয়া পর্য্যন্ত ন্যাটো ইউক্রেনের আকাশ নো-ফ্লাইংজোন হিসাবে ঘোষণা করতে রাজি হয়নি। ফলে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ন্যাটোকেই হুঁশিয়ারী দিয়ে রেখেছেন। এবার প্রতিটি মৃত্যুর কারণে ন্যাটোর হাতেও রক্তের দাগ লেগে থাকবে বলে। ন্যাটোকে তাদের দুর্বলতার জন্য তিরস্কার করতেও পিছপা হননি তিনি। রুশ বাহিনীর যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার উদ্দেশ্য যে ব্যর্থ হয়েছে। সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। যাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া। তাঁরাই এখন ইউক্রেনের হাতে পণবন্দী। এবং সেই সুযোগে ইউক্রেন বাহিনী নিজেদের সামরিক অবস্থান মজুবুত করে নেওয়ার চেষ্টায় বেশ কয়েকটি স্থানে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করেছে। ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থায় নেই। ফলে তাদের প্রক্সি ওয়ার অর্থাৎ ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে মার্কিন স্বার্থে। মাঝখান থেকে ইউক্রেনের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী সেই প্রক্সি ওয়ারের মাঝে পড়ে আপাতত দিশেহারা। দিশেহারা নই আমরা। আমরা জানি। কোন টিভি চ্যানেল। কোন ওয়েব সাইট। কোন খবরের কাগজ খুলে বর্তমান পরিস্থিতির খবর নিতে হবে। আর কোন টিভি, ওয়েবসাইট, খবরের কাগজে দৃষ্টি দেওয়া নিষেধ। এই নিষেধাজ্ঞা না মানলে গণতন্ত্র বিপন্ন। বাক স্বাধীনতা স্তব্ধ্
৫ই ফেব্রুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত