লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে মাসে পাঁচশো টাকা প্রাপ্তির জন্য পঁচিশ থেকে ষাট বছরের মহিলাদের পথে নামিয়ে দিয়েছে সরকার। দূয়ারে সরকার। অতয়েব বাড়ির মহিলাদের তো আর বাড়িতে বসে থাকার উপায় নাই। স্বহস্তে ফর্ম তুলতে হবে। কে কার আগে ফর্ম তুলবে। তাই ঠেলাঠেলি। সারাদিন লাইনে গুঁতোগুঁতি করে যদি একটা ফর্ম তোলা যায়। তাই যেখানেই দূয়ারে সরকার টেবিল চেয়ার পেতে বসে গিয়েছে। সেখানেই লাখো মহিলার ভিড়। মাসে পাঁচশ টাকা কম কথা নয়। কিছু না করতেই সরকার প্রতিমাসে দিয়ে যাবে। ফলে সরকারের এহেন জনদরদী জনমুখী প্রকল্প থেকে জনতা মুখ ঘুড়িয়ে থাকে কি করে। তাই বাড়ির মহিলারা দলে দলে ভিড় করেছে দূয়ারে সরকারের প্রকল্পে। রাস্তা জুড়ে দীর্ঘ লাইন। ভিড়ে ঠেসাঠেসি। গাদাগাদি। সংক্রমক লকডাউনের সময় মহামারী বিধি শিকেয় তুলে মানুষ মানুষের সঙ্গে আবার স্বাভাবিক নৈকট্যে ফিরে এসেছে। লকডাউনের সোশ্যাল ডিস্টেনসিং মেইনটেন করতে গেলে আর ফর্ম পাওয়া যাবে না। তাই সেসব নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাচ্ছে না। এমন কি মাসে পাঁচশো টাকা জোগার করার ফর্ম তুলতে গিয়েও যদি করোনায় সংক্রমিত হয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটে যায়, তাতেও পিছপা নয় কেউই। সকলেরই ভরসা করোনা নয়। ফর্ম নিয়েই বাড়ি ফিরতে পারবে। ফলে দূয়ারে সরকার আম জনতার কাছে সাংঘাতিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাসে মাসে মাগনা পাঁচশো টাকাই বা আসে কোথা থেকে। হোক সে পাঁচশ টাকা। দুই কেজি রুই বড়োজোর দেড় কেজি কাতলার বেশি মাছও নাহয় সে টাকায় কেনা যায় না। তাতে কি? কেউ তো আর মাসে মাসে পাঁচশো টাকা ভিক্ষেও দেবে না। সরকারই নাহয় দিলো। সরকার তো জনগণেরই সরকার। সরকারের কাছ থেকে আবার ভিক্ষে নেওয়া কি? এতো জনগণের হকের টাকা। মাসে মাসে পাঁচশ করে। কম কথা নয়। ভাগ্গিস জনতা পরিবর্তন চেয়েছিল সেই ২০১১তে। বাংলার জনগণের দূরদর্শিতা ইতিহাসে স্থান পেয়ে গিয়েছে। জনতা পরিবর্তন না চাইলে আজ দূয়ারে সরকার আসতো নাকি? ফ্রীতে রেশন। ফ্রীতে চিকিৎসা। ফ্রীতে পাঁচশো টাকা। বাকি লিস্টের কথা নাহয়ে উহ্যই রইল। চিত্রগুপ্তের লিস্ট যত খুলবে তত খুলতেই থাকবে। শেষ হবে না।
কিন্তু হলে হবে কি বাংলা নিন্দুকের দেশ। কোন ভালো কাজের কদর নেই এদেশে। যত ভালো কাজই করো না কেন নিন্দেমন্দ ঠিকই শুনে যেতে হবে। কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে? জনসেবার অনুপ্রেরণায় জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে না। সরকারের দায়িত্ব কম? কাদের জন্য সরকার? জনগণের জন্যই তো। তাহলে সেই জনগণের হাতে কিছু নগদ অর্থ তুলে দিলে তাতেও নিন্দেমন্দ? লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বাৎসরিক এগারো হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। কম কথা? একটা সরকার বছর বছর এতগুলি টাকা জনগণকে ফ্রীতেই দিয়ে দেবে। তাতেও সমালোচনা? আশ্চর্য্যই বটে। নিন্দুকের দল এর ভিতরেই হিসেব করতে শুরু করে দিয়েছে, বছরে এই এগারো হাজার কোটি টাকায় কতজনকে চাকরি দেওয়া যেত। কোন কোন পে-স্কেলে কতজনকে কি কি ধরণের চাকরি দেওয়া যেত। যাতে মাস মাসে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকার বেতন থেকে আশি নব্বই হাজার টাকা অব্দি বেতনও নাকি দেওয়া যেত। সে এক বড়ো ফিরিস্তি। কত লক্ষজনের তাতে চাকরি হয়ে যেত নাকি। বছর বছর সরকার যদি এই এগারো হাজার টাকা বেতন খাতে ব্যায় করে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতো। না, এসব নিন্দুকের কথা। আমরা যারা দূরদর্শী বাঙালি ভোটার। আমরা যারা পরিবর্তন চাই হোর্ডিং এর তলায় সমবেত হয়েছিলাম। আমরা এসব নিন্দুকের কথায় টলছি না। টলবো না। নিন্দুকেরা যে হিসেবই দিক। আমরা সাধারণ পাটিগণিতেই বুঝতে পারি লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে সরকার যত কোটি মহিলাদের এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের আওতায় নিয়ে এসে মাথাপিছু পাঁচশ টাকা করে দিতে পারবে। তার দশ শতাংশ মানুষকেও ন্যূনতম ২০ হাজার টাকার বেতনের চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। এতো জলের মতোই পরিস্কার। একটা জনগণের সরকার, তার সবসময়ের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত? যত বেশি জনগণকে খুশি রাখা যায়। আর সেই খুশির তালিকায় যদি প্রত্যেক বাড়ির মা বোনেরা খুশি থাকে তবে তার থেকে ভালো কি হতে পারে? বাড়ির ছেলেরা তো কতরকম করেই না হয় রোজগার করতে পারবে। কিন্তু মা বোনরা? সকলেই কি টাকা রোজগার করছে? না করতে পারে? তাদের জন্য কে ভাববে? এই প্রথম একটি সরকার তাদের জন্যেও তো ভাবতে শুরু করেছে। সেকথা স্বীকার করতে হবে না? এবং কাউকেই বঞ্চিত হতে হবে না। এই এগারো হাজার কোটি টাকায় বাংলার প্রায় সব মা বোনেরাই মাসে মাসে পায়ের উপরে পা তুলে পাঁচশো করে টাকা পেয়ে যাবে। এহেন জনমোহিনী প্রকল্পেরও নিন্দেমন্দ করতে হয়? ধম্মে সইবে?
আর ছেলেরা? তাদের জন্য তো কত উপায়ই রয়েছে রোজগার করার। পাড়ায় পাড়ায় জমি বাড়ি কেনাবেচায় তোলাবাজি নেই? কোন পাড়াটা বাদ রয়েছে? কোনখানে তোলাবাজি নেই? কোন বিষয়ে তোলাবাজি নেই? ক্লাবে ক্লাবেই কি সরকার কম টাকা ঢালছে? ঢেলেছে এক দশক ধরে? সেই টাকা যাচ্ছে কোথায়? খাচ্ছে কারা? সেই ছেলেরাই তো নাকি? শুধু কি তাই? যে যেখানে কোন না কোন সরকারী পদে বা প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে। কাটমানি খাচ্ছে না? কে বাদ রয়েছে কাটমানির সুযোগ ও সুবিধে থেকে? তারপরেও ছেলেদের হাতে টাকা নেই বলে প্রচার করলে জনতা হাসবে না? তারপর সরকারী অনুদান থেকে চুরির ভাগই কি কম? সেই ভাগের বখরা তো ছেলেদেরই পকেটে নাকি। হ্যাঁ বাড়ির মেয়েদের খুব কমই এই সব সুযোগ সুবিধে পেয়ে থাকে। হাতে গোনা কয়েকজনের বেশি নয় নিশ্চয়ই। সেই কারণেই তো সরকারের কত রকমের প্রকল্প শুধু বাড়ির মেয়েদের কথা চিন্তা করেই।
হ্যাঁ অনেকেই আক্ষেপ করেন ঠিকই। সরকারী বহু পদে গত দশ বছরে কর্মসংস্থান নেই। স্কুল কলেজে বহু শিক্ষক পদ খালি পড়ে রয়েছে। নিয়োগ নেই। রাজ্যে নতুন শিল্প স্থাপনের পথ বন্ধ। কিন্তু এটাও তো ঠিক। ভারতবর্ষ জুড়েই কি এই একই চিত্র নয়? ভারত সরকার তো একের পর এক সরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে। বিক্রী করে দিচ্ছে। কর্ম সংস্থান হওয়া তো দূরের কথা সরকারী কর্মীদেরই চাকরি চলে যাচ্ছে লাখে লাখে। সারা ভারতেই বা নতুন শিল্পস্থাপনের সুযোগ কতটুকু? ফলে নিন্দুকের কথায় তাল দিয়ে শুধুই নবান্নের দোষ দিলে হবে? কেন্দ্ররাজ্য তালে তাল দিয়ে না চললে হবে কি করে? এটাই তো ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামো। কেন্দ্র রাজ্য সহযোগিতার ভিতরেই দেশের স্থিতি। সেই স্থিতিতে প্রলয় বাঁধিয়ে দিলেই হলো নাকি? এদিকে লাখো লাখো শূন্য পদে কর্মসংস্থান করে দিলে, বেতন দিতেই তো সব টাকা শেষ হয়ে যেত। তখন দূয়ারে সরকার কে করতো? কোটি কোটি মহিলাদের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকার এক একটা প্রকল্প পৌঁছিয়ে দেওয়া যেত? এই সামান্য হিসেবটা নিন্দুকদের করার দায় নাই থাকতে পারে। তাদের দায় তো একটাই। বিরোধীতা করার জন্যেই বিরোধীতা করা। কিন্তু জনগণ সব দেখছে। জনগণকে বেকুব বানানো অতই সহজও নয়। জনগণের হিসেবে ভুল নাই। কয়েক লক্ষ চাকরির থেকে কোটি কোটি মানুষের হাতে দান ক্ষয়রাতির অর্থ তুলে দিতে পারাই জনগণের পাশে থাকার আসল পথ। তার সাথে তোলাবাজি কাটমানি ঘুষ ও ঘুষির প্রভিশন থাকলে তো সোনায় সোহাগা। তারপরেও তো ভুয়ো আইএএস আইপিএস সিবিআই সেজে অর্থ রোজগারের সোজা পথ খোলাই রয়েছে। কে বারণ করেছে? হাওয়ায় টাকা ওড়ে ধরে নিতে পারলেই হলো। না পারলে সরকার তো রয়েইছে। দূয়ারে সরকার পৌঁছিয়ে দিতে। বাঁকা পথে অক্ষমদের জন্য সোজা পথে সরকার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তার জনগণের কাছে। তাই নিয়েও নিন্দেমন্দ। এদের কখনো ভালো হয়? না হওয়া উচিত?
১৯শে আগস্ট’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত