একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, বাঙালি মাত্রেই আমরা সাম্প্রদায়িক। আবার শুধু যে সাম্প্রদায়িক তাও নয়। আমরা গভীর ভাবে জাতপাতেও বিশ্বাসী। আমরা প্রথমেই দেখে নিই, কে হিন্দু কে মুসলিম। তারপরেই দেখি কে নীচু জাত। কে উঁচু জাত। আর এই দেখে নেওয়ার পর্ব শুরু হয়, আমাদের নাম ও পদবী দেখা থেকেই। তারপর পোশাক আশাক দেখেও অনকটা পার্থক্য ধরা পড়ে অনেক সময়েই। আর পড়ে বলেই বাঙালি না হয়েও দেশ প্রধান খুব একটা ভুল বলেননি যে, পোশাক দেখে মানুষ চেনা যায়। এখানে মানুষ বলতে উনি সাম্প্রদায়িক পরিচিতি বোঝাতে চাইলেও, তার সাথে জাতপাতের পরিচিতির ক্ষেত্রেও কথাটা অনেক সময়েই খেটে যায়। কারণ অনেক সময়েই আমরা পোশাক দেখে ছোটো জাত উঁচু জাত অনুমান করে নিই। ঠিক হোক আর বেঠিক হোক। তার আসল কারণ, ছোট জাত হলে আর্থিক সঙ্গতি কম হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে পোশাকে তার ছাপ থাকারও কথা। ঠিক একই কথা খাটে উঁচু জাতের ক্ষেত্রেও। সোজা কথা, বোঝা যাক আর না যাক, আমরা কিন্তু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। কে কোন সম্প্রদায়ের কে কোন উঁচু কিংবা নীচু জাতের। মানুষের নাম পদবী এবং পোশাকআশাক দেখে। কিন্তু কেন এই প্রবণতা আমাদের? তার প্রধান কারণ একটাই। আমরা বাঙালিরা কোনদিন বাঙালি জাতীয়তায় বিশ্বাসী নই। মাতৃভাষা বাংলা হওয়া, কিংবা বাংলার ভুখণ্ডের মানুষ হওয়াকেই আমরা বাঙালিত্বের শেষ কথা বলে মানতে পারিনি কোনদিন। হিন্দু বাঙালির চেতনায় বাঙালি আবার মুসিলম হয় কি করে। আবার মুসলিম বাঙালি বিশেষত অধুনা যাঁরা নিজেদের বাংলাদেশী বলে মনে করেন। তাঁদের ভিতর একটা বড়ো অংশের মুসলিম বাঙালির চেতনায় হিন্দু বাঙালি আসলে বাঙালি নয়। তারা ইণ্ডিয়ান। উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালিদের কাছে নিম্ন বর্ণের হিন্দু বাঙালিরাও স্বগোত্র নয় আদৌ। ফলে তাদেরকে নিজ বাঙালি জাতির অংশ মনে করতেও হোঁচোট খেতে হয় রীতিমত। ফলে সোজা কথায় এক আকাশের নীচে এক ভুখণ্ডের মাটিতে বাঙালি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ে এবং উঁচু জাত নীচু জাতে নানা ভাবে বিভক্ত। এবং প্রত্যেক ভাগ এক একটি গোষ্ঠী মানসিকতায় চলে। এই যে গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতা। এটি বাঙালির স্বভাব চরিত্র। বাঙালি তাই কোনদিন ক্ষুদ্র গোষ্ঠী চেতনার উর্দ্ধে উঠে বাঙালি জাতীয়তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতেই পরেনি।
এই না পারা থেকেই সে সর্বদা গোষ্ঠী পরিচয়ের বৃত্তেই পরস্পরকে চিহ্নিত করে এসেছে। কাউকে মুসলিম। কাউকে হিন্দু। কাউকে ব্রাহ্মণ। কাউকে শুদ্র। কিন্তু কাউকেই সে বাঙালি বলে চিহ্নিত করতে পারেনি। ঠিক যে কাজটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশ থেকে শুরু করে প্রতিটি অবাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠীই বাঙালি সম্বন্ধে করে এসেছে। অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ভাবেই যে কোন অবাঙালি মানুষ বাংলাভাষী মানুষকেই বাঙালি বলে চিহ্নিত করে। কখনোই হিন্দু বাঙালি কি মুসলিম বাঙালি, ইণ্ডিয়ান বাঙালি কি বাংলাদেশী বাঙালি, উঁচু জাতের বাঙালি কি নীচু জাতের বাঙালি বলে আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করে না। তাদের কাছে, আমরা যারা বাঙালি, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাদের যাদের মাতৃভাষাটাই বাংলা। সকল অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে আমরা কিন্তু বাঙালি। শুধু বাঙালিদের কাছেই বাঙালি কোন অখণ্ড জাতিসত্তায় প্রতিভাত হয়ে উঠতে পারেনি কোনদিন। আজও আমরা কেউ আগে ভারতীয়। তারপরে বাঙালি। কেউ আগে বাংলাদেশী তারপরে বাঙালি। কেউ আগে হিন্দু তারপরে বাঙালি। এবং সকল হিন্দুই যার কাছে স্বজাতি বলে প্রতিভাত। কেউ আগে মুসলিম তারপরে বাঙালি। এবং সকল মুসলিমই যার কাছে স্বজাতি বলে প্রতিভাত। এইভাবে কেউ আগে ব্রাহ্মণ কায়স্থ তারপরে বাঙালি। ফলে প্রায় প্রতিটি বাঙালিই আগে অন্য কিছু। তারপরে ভাগ্য বিড়ম্বনায় বাঙালি। খুব কম বাঙালি রয়েছেন। যাঁরা মনপ্রাণে বাঙালি। যাঁরা বাংলাভাষী প্রতিটি মানুষকেই আপন স্বজাতি বলে স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা।
এবং সবকিছুর উর্ধে আমাদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয়। সেই পরিচয়কে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েই আমাদের জীবনযাপন। জীবন যাপনের প্রতিটি মুহুর্ত। বাঙালির সমাজ নানান গোষ্ঠীতে বিভক্ত থেকে পরস্পর থেকে সম দূরত্ব বজায় রেখে চলায় বিশ্বাসী। কিন্তু তার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে সে এমন অনিবার্য্য বলে মনে করে যে, অপর সম্প্রদায়ের বাঙালিকে সে আপন জাতির অংশ বলেই আজও মনে করে উঠতে পারে না। ফলে এক সম্প্রদায়ের বাঙালির চোখে অপর সম্প্রদায়ের বাঙালি, বাঙালি বলেই স্বীকৃত নয়। হ্যাঁ খাতায় কলমে সেকথা মেনে নিতে বাধ্য হলেও, সামাজিকতায় এবং ব্যক্তি জীবনের পারিবারিক বৃত্তের সংস্কৃতিতে সেকথা মেনে নিতে পারেনি কোনদিন। এই না মেনে নিতে পারাই বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্য। দুই সম্প্রদায়ের বাঙালিই এই জাতীয় ঐতিহ্যকে পারিবারিক এবং সামাজিক সূত্রে উত্তরাধিকার হিসাবে বহন করে নিয়ে চলেছে শতকের পর শতক। আর এইখানেই বাঙালি, হিন্দু মুসলিমে আজও বিভক্ত। ধর্ম এখানে মানুষকে উন্নত করে তোলার বদলে, খর্ব করে রেখে দিয়েছে। ধর্ম এখানে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহক হয়ে বাঙালিকে নিদারুণ ভাবে বিভক্ত করে রেখে দিয়েছে। ধর্ম যখন একটি জাতিকে বিভক্ত করে ফেলে। সে ধর্ম যতই মহান হোক না কেন, সেই ধর্ম সেই জাতির পক্ষে অভিশাপ স্বরূপ। অনেকেই কি হিন্দু কি ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন, কোন ধর্মই অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করার শিক্ষা দেয় না। কোন ধর্মই বিভেদ বিদ্বেষ বিচ্ছিন্নতার কথা বলে না। কোন ধর্মই মানুষকে অমানবিক আচরণে প্রলুব্ধ করে না। ভালো কথা। সে ধর্মপুস্তকের কথা হতে পারে। শাস্ত্রের বচন হতে পারে। কিন্তু যখন কেউ ধর্ম পালন করতে গিয়ে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী স্বজাতির মানুষকে আপন বলে বুকে টেনে নিতে অক্ষম হয়, বুঝতে হবে সেই অক্ষমতার জন্ম তার ধর্মবোধের ভিতরেই। অন্য কোথাও নয়। ধর্মপুস্তকে শাস্ত্রবচনে যাই থাক। মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনে যে ধর্মবোধ বাঙালিকে হিন্দু মুসলিমে উঁচুজাত নীচু জাতে বিভক্ত করতে থাকে। সেই ধর্মবোধ হিন্দু হোক বৌদ্ধ হোক খৃষ্টান হোক ইসলাম হোক, যাই হোক না কেন, জাতি হিসাবে বাঙালির জীবনে অভিশাপ স্বরূপ। এবং এই অভিশাপ থেকেই বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতি আর বাঙালি মুসলিমের সংস্কৃতি আজ পৃথক হয়ে গিয়েছে। তার কোনটাই আর অখণ্ড বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে টিকে নাই। ব্যক্তি জীবনের পরিসরে পারিবারিক বংশকৌলিন্যের উত্তরাধিকারে এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংস্কৃতির আধারে এই কারণেই প্রতিটি বাঙালি কোন অখণ্ড বঙ্গসংস্কৃতির ধারকও নয় বাহকও নয়। তার সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় ও গোষ্ঠী আচারে ভিন্ন। এই কারণেই আমরা অধিকাংশ বাঙালিই আসলে সাম্প্রদায়িক। আর সেই সাম্প্রদায়িকতা আমাদের ধর্মবোধ জাত। এবং এটি জাতি হিসেবে বাঙালির সবচেয়ে বড়ো ও প্রধান অভিশাপ। ঠিক সেই অভিশাপেই বাঙালি আজও একটি অখণ্ড জাতিসত্তায় গড়ে উঠতে পারেনি। এবং যতদিন মানুষের সমাজ ও সভ্যতায় ধর্ম টিকে থাকবে। ততদিন বাঙালিও সাম্প্রদায়িক থেকে যাবে। কোনদিন অখণ্ড একটি বাঙালি জাতিসত্তায় আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না মাথা উঁচু করে। চিরকাল মাথা নীচু করে বিশ্বের সকল জাতির পিছনে পড়ে থাকবে সেই সাম্প্রদায়িক ধর্মবোধের দাসত্ব করতে করতে। এটাই বাঙালির জাতি হিসাবে নিয়তি। ফলে আমাদের জীবন যাপনের পরতে পরতে এভাবেই আমরা খণ্ড বিখণ্ড থেকে যাবো। এই ভাবেই খর্ব থেকে যাবো। একটি জাতি যতক্ষণ না আপন জাতিসত্তায় উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। ততক্ষণ তাকে অন্যান্য জাতির দাসত্ব করতে হবেই। বাঙালি হিন্দু মাত্রেই এই সত্য উপলব্ধিতে অক্ষম। কারণ সে নিজেকে হিন্দু জানে। বাঙালি মুসলিম মাত্রেই এই সত্য উপলব্ধিতে অক্ষম। কারণ সেও নিজেকে মুসলমান জানে। আর কি হিন্দু কি মুসলিম, বাঙালি মাত্রেই নিজেকে কোন অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার অংশ বলে স্বীকার করতেই রাজি নয়। তাই আমরা সকল বাংলাভাষী যারা, তারা নাম পদবী পোশাক দিয়েই পরস্পরকে চিরকাল বিচ্ছিন্ন করে রাখবো। কোনদিনও পরস্পরের সাথে মিলতে পারবো না। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলবো। কিন্তু সাম্প্রদায়িক অস্তিত্বের উর্ধে উঠতে পারবো না কোনদিন। আমাদের আত্মার ভিতরেই সেই শক্তি নেই। আমাদের অবরুদ্ধ চেতনার ভিতরেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ গভীর শিকড় বিস্তার করে বসে রয়েছে। এক ভুখণ্ডের মাটিতে থেকেও আমাদের অস্তিত্ব আলাদা। না, এমন কোন জাতির হদিশ সম্ভবত পৃথিবীতে আর পাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মবোধ আর কোন জাতিকেই এমন আড়াআড়ি ভাবে কেটে দুটুকরো করতে পারেনি। যেমনটা বাঙালিকে পেরেছে।
৬ই আগস্ট’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত
যথার্তই, ধর্মই বাঙ্গালির প্রধান প্রতিপক্ষ।
LikeLike
একদম।
LikeLike