এবারের বিধানসভা নির্বাচনের পর্বে পদ্মশিবিরের সভাপতির গাড়ীর কনভয়ের উপরে রাজ্যের শাসকদলের কর্মীসমর্থকদের হামলার ঘটনা অনেকেই হয়তো ভুলে জাননি এর মধ্যেই। সেই হামলা নিয়ে দুই শিবিরের ভিতর রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়িও কম হয়নি। আমাদের দেশে এই সব হামলা অবরোধ ভাঙচুড় হলেই এক দল আরেক দলের কর্মীসমর্থকদের দুষ্কৃতী বলে সম্বোধন করে থাকে। এবং হামলা প্রতিরোধ অবরোধের সম্মুখীন হলেই, সেসব বিপক্ষ দলের পোষা গুণ্ডাদের কাজ বলে অভিযোগ করে থাকে। অপর দলটি সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টিকে জনবিক্ষোভ জনতার প্রতিরোধ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আর এইটিকেই আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে থাকি। ঠিক একই কাণ্ড আজকেই ঘটে গেল। ত্রিপুরার আগরতলায়। শুধু ভুমিকা পাল্টিয়ে গেল। আজ হামলার শিকার হতে হলো ঘাসফুল শিবিরের সর্বভারতীয় সভাপতির কনভয়কে। অভিযোগের তীর ত্রিপুরার শাসকদলের দিকে। এখানেও দুই দলের পরস্পরের ভিতর অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের ভাষা ও যুক্তি একই। তফাৎ শুধু ডায়মণ্ডহারবারে যে দল হামলার শিকার হয়েছিল। ত্রিপুরায় সেই দলই হামলাকারী। পশ্চিমবঙ্গে যে দলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ ছিল। আজ ত্রিপুরায় তারাই হামলার শিকার। অর্থাৎ হামলা ও হামলার শিকার হওয়া। দুইই একই রাজনৈতিক সংস্কৃতির এপিঠ আর ওপিঠ। এক জায়গায় যে হামলার শিকার। অন্য জায়গায় সেই হামলাকারী। এক জায়গায় যে হামলাকারী অন্য জায়গায় সেইই হামলার শিকার। এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপের ভাব ভাষা যুক্তিও যেমন এক। ঠিক তেমনই হামলার পক্ষে যুক্তি সাজাতে হামলাগুলিকে স্বতঃস্ফূর্ত জনবিক্ষোভ বলে চালানোর সংস্কৃতিও এক এবং অভিন্ন। রাজনৈতিক দলগুলির নাম প্রতীক পতাকার রঙ ভিন্ন হলেও কর্মপদ্ধতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি অভিন্ন। যে যেখানে শাসকদলের ভুমিকায়। সে সেখানেই হিরো। ফলে সে তার আপন গড়ে যে ঘটনাকে স্বত্ঃস্ফূর্ত জনবিক্ষোভ বলে চালিয়ে থাকে, সেই একই ঘটনা অন্যদলের এলাকায় ঘটলেই সেটি হয়ে যায় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব। আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে আসার ডাক দিয়ে জনমানসে জনদরদী সাজার নাটক। যে নাটকের আরেক নাম রাজনীতি।
সেই রাজনীতির যাত্রাপালাই প্রতিদিন অভিমীত হতে থাকে। আর টিভির পর্দায় তারই নিরন্তর টেলিকাস্ট। সান্ধ্যটিভির জলসায় পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রী কর্মীসমর্থকদের প্রতিদিনের তরজাতেও অনুরূপ বাদানুবাদ চিৎকার চেঁচামেচি হই হট্টগোলে কান ঝালাপালা হতে থাকে সকলের। প্রত্যেক দলের মুখপাত্রদের একটাই লক্ষ্য থাকে বিপক্ষ দলের কথা দর্শক শ্রোতার কান অব্দি গিয়ে পৌঁছাতে পারে না যেন। সকলেই সেই উদ্দেশে গলার ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচামেচি করতে থাকে। এটাকেই আবার আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে চালিয়ে থাকি। এবং প্রতটি দলের রাজনৈতিক বাদানুবাদের পারস্পরিক দোষারোপের যুক্তিগুলির ভাব ও ভাষা হুবহু এক এবং অভিন্ন। এবং সেই এক ও অভিন্ন যুক্তিতেই প্রত্যেকে নিজেকে সাধু এবং জনদরদী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অসাধু এবং জনবিরোধী হিসেবে প্রতিপন্ন করে সভা শেষ করে। টিভির জলসা থেকে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল জনসভা। সবখানেই এক এবং অভিন্ন চিত্র। প্রতটি রাজনৈতিক দলই সৎ, দেশপ্রেমী এবং জনদরদী। আর প্রতিটি বিপক্ষ শিবির অসাধু এবং জনবিরোধী এবং সময়ে সময়ে দেশদ্রোহী। কোন রাজনৈতিক শিবিরের মুখের ভাষা ভাষণের যুক্তি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি একের থেকে অপরে ভিন্ন নয়। ভিন্ন নয় তাদের রাজনীতির কর্মপদ্ধতিও। ভিন্ন শুধু দলীয় সাইনবোর্ডটি। ভিন্ন শুধু দলীয় নির্বাচনী প্রতীকটি। ভিন্ন শুধু দলীয় পতকার রঙটি।
এই যে অভিন্ন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। অভিন্ন এক রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি। এটাই আমাদের গণতন্ত্রের দেউলিয়েপনাকে নিশ্চিত করে। রাজনীতি এখানে যেনতেন প্রকারে শাসনক্ষমতা অধিকার করার লড়াই। ফলে সেই লড়াইয়ের রীতি পদ্ধতি নীতি মতাদর্শের ভিতরে পার্থক্যও নেই কোন। মূল লক্ষ্য যেখানে ক্ষমতার প্রাসাদের দখল নেওয়া। সেখানে সেই দখল নেওয়ার লড়াইয়ে সামিল প্রত্যেকের সংস্কৃতিই এক ও অভিন্ন হতে বাধ্য। ফলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিটি দল প্রতিটি দলকে অনুসরণ করে চলেছে। কাজে পদ্ধতিতে লক্ষ্যে এবং সংস্কৃতিতে। এই কারণেই দলগুলির পরস্পরের ভিতরে পারস্পরিক অভিযোগগুলিও এক এবং অভিন্ন। কোন দলকেই দেখা যায় না জনতার স্বার্থকে সামনে রেখে এগিয়ে চলতে। প্রতিটি রাজনৈতিক শিবির কেবলমাত্র ক্ষমতার শীর্ষে গিয়ে পৌঁছিয়ে দেশের সম্পদের উপরে একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করার লক্ষ্যেই রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করে। দেশ নয়। দেশবাসী নয়। শুধুই দল আর দলীয় স্বার্থ পূরণের দাবিতে তাদের যাবতীয় উদ্যোগ ও সাধনা। জনতা সেখানে ঘুটি মাত্র। জনতার স্বার্থ নয়। জনতার উপরে কর্তৃত্ব করার অধিকার অর্জনের উদ্দেশেই গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে যাবতীয় লম্ফঝম্ফ। পারস্পরিক বাদানুবাদ। দোষারোপ অভিযোগ আর বিষোদ্গার। তাই একদলের কনভয়ে হামলার পাল্টায় আরেক দলের কনভয়ে হামলা চালাতে হয়। সাধুভাষায় যাকে পারস্পরিক কামড়াকামড়িও বলা চলে। শুধু সময়ের সাথে যুক্তিটা বদলিয়ে যায়। বক্তা একই থাকে। একই জায়গায় দাঁড়িয়েও থাকে। চলতে থাকে পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির অনন্ত পর্ব। যাকে আমরা রাজনীতি বলে চালিয়ে থাকি।
২রা আগস্ট’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত