অবশেষে সরকারী হাসপাতালে ছয়টি ডোমের পদে চাকরির প্রত্যাশায় একশ ইঞ্জিনিয়ার সহ কয়েক হাজার গ্র্যজুয়েট পোস্ট গ্র্যজুয়েট কর্মপ্রার্থী আবেদন পত্র জমা দিয়েছেন। যে পদে চাকুরির ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারিত হয়েছে অষ্টম শ্রেণী পাশ। রাজ্যে সরকারী বেসরকারী চাকরির পরিসর সীমিত হতে হতে কোন অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে, সেটি বুঝতে আর বেশি কিছু তথ্য জানার প্রয়োজন পড়ে না। পরিবর্তনের পর একদশকে রাজ্যে কোন শিল্প স্থাপন হয়নি। নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সরকারের বিশেষ কোন ভাবনা চিন্তা রয়েছে বলেও জানা যায় না। একদশকীয় শাসনামলে প্রথম প্রথম ঢাক এবং ঢোল ফাটিয়ে বিদেশী লগ্নী নিয়ে আসার কথা বলে প্রচুর মৌ স্বাক্ষরিত হতো বলে জানানো হতো আমাদের। কিন্তু তাতে রাজ্যে শিল্পবাণিজ্যের কতদূর প্রসার হলো। অর্থনীতি কতটা সবল হলো। কর্মসংস্থানের দরজা কতটা হাট করে খুলে গেল। এই বিষয়গুলি এই মুহুর্তে গ্রেটার ইভিল লেসার ইভিল কাজিয়ায় চাপা পড়ে গিয়েছে। সরকারী বিদ্যালয়গুলির হাজার হাজার শূন্যপদের দিকে তাকিয়ে দিন গুনছে কোটি কোটি কর্মপ্রার্থী। কিন্তু সেখানেও দূর্নীতির ঘুঘু এমন ভাবেই বাসা বেঁধেছে যে, চাকরি পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি সরকার আর আদালতের দঁড়ি টানাটানির ভিতরে আটকিয়ে রয়েছে। ফলে গত দশবছরে সরকারী এবং বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান বন্ধ। বদলে চপ শিল্পের উৎকর্ষতার বিষয়ে রাজ্যজুড়ে প্রথম প্রথম বেশ চর্চা শোনা যেত। আজকাল অবশ্য সেই চর্চা ততটা চলছে না মনে হয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র খুলতে অস্থায়ী সিভিক ভলেন্টিয়র আর টোটো চালানোর বন্দোবস্ত ছাড়া আর বিশেষ কিছু হয়েছে বলে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু মজার কথা, তারপরেও শাসকদলের জনসমর্থন আকাশচুম্বী!
আবার এটাও সার্বিক চিত্র নয়। একই সময়ে রাজ্যে বহু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য দপ্তরে অনেক অবাঙালি কর্মপ্রার্থী চাকরি জোগার করে নিতে পেরেছে। সেটি মালুম হয় ব্যাংকগুলিতে গেলে, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে গেলে, অল্পবয়সী হিন্দী বলিয়ে সদ্য জয়েন করা সরকারী কর্মীদের দেখলেই। আর পুলিশ বিভাগে অধিকাংশ উচ্চপদেই যেভাবে অবাঙালি আধিকারিকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে দ্রুত হারে, তাতে ভাবতেই অবাক লাগে রাজ্যটি ইউপি কিংবা বিহার নয়। বাংলায় চাকরি নেই সত্য, নাকি বাঙালির চাকরি নেই সত্য। এই প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হবে আমাদের খুব তাড়াতাড়ি। অর্থাৎ যেটুকু বা চাকরি হচ্ছে। তার বেশিরভাগই দখল করে নিচ্ছে অবাঙালিরা। মজার বিষয়। এই ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই সমান সমর্থন রয়েছে। উল্টে বাঙালির জন্য কর্মসংস্থানের সংরক্ষণের কথা বললেই প্রায় সব দলই রে রে করে তেড়ে আসে বিরোধীতা করতে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কর্মসংস্থানের জন্য সেই সেই রাজ্যবাসীর সংরক্ষণ থাকবে। সেটি প্রাদেশিকতা নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদ বাদ নয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির ছেলে মেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্য কোন রকম সংরক্ষণ করা চলবে না। এই একটি বিষয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এক রা। এর পিছনেই রয়েছে ভোট রাজনীতির সূক্ষ্ম হিসেব। সকল রাজনৈতিক দলই জানে বিগত পাঁচ দশকে অবাঙালিদের অনুপ্রবেশ বাড়তে বাড়তে রাজ্যে অবাঙালিদের মোট সংখ্যা অনেকদিন আগেই ত্রিশ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ফলে এই অবাঙালিরা রাজ্যের প্রতিটি নির্বাচনে এক বিপুল ভোটের অংশ। সেই ভোটটি কোন দলেরই হাতছাড়া করার হিম্মত নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই জানে একবার পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির কর্মসংস্থানের জন্য সংরক্ষণের দাবি তুললে অবাঙালি ভোটের গোটা অংশটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফলে তারা বাঙালির জন্য কোন কিছু দাবি করতে চাইবে না। তাতে ঘরে ঘরে বাঙালি বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকুক। সেও ভালো। কিন্তু রাজ্যের অবাঙালিদের চটানো যাবে না। বরং তাদের কত বেশি জামাই আদরে রাখা যায়, সেই দিকেই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সদা সজাগ দৃষ্টি। এই বিষয়ে ক্ষমতায় যেই আসুক, তারই এক নীতি। সদ্য অনুষ্ঠিত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বে গোটা বিহার জুড়ে প্রচার করা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে এবারে পদ্মফুটলে লাখ লাখ বিহারীদের চাকরি হবে। প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যে বসবাসকারী বিহারবাসীরা যাতে সব দলে দলে পদ্মফুলে ছাপ দেয়। সেই প্রচার যে একেবারে বৃথা যায়নি। তার প্রমাণ রাজ্যের নির্বাচনী পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই মালুম হবে।
এরসাথে আরও একটি বিষয় যুক্ত। রাজ্যে অধিকাংশ অবাঙালি মালিকাধীন ব্যবসা বাণিজ্যে অবাঙালিদেরই চাকরিতে অগ্রাধিকার। এই বিষয়টি বেশ নিঃশব্দে ঘটে চলেছে। এবং স্বাভাবিক কারণেই রাজ্যের সব কয়টি রাজনৈতিক দলের মুখে কুলুপ। চোঠে ফেটি। কানে তুলো। একদিকে সরকারী পরিকল্পনার কোন ঠিকঠিকানা নাই। সরকারের অর্থনীতি বাণিজ্যনীতির সঠিক কোন দিশা নাই। অন্যদিকে কেন্দ্র সরকার অধিকাংশ সরকারী সংস্থা জলের দরে বিক্রি করে দিয়ে কর্মসংস্থান কমিয়ে দেওয়ার লক্ষে সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলেছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য, কোন সরকারের দেশের যুবসম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের বিষয়ে কোন দায় নেই। একজন চপ শিল্পের পক্ষে ওকালতি করে তো অন্যজন পকৌরা শিল্পের দিকে যুবসমাজকে ঠেলা মারে। এরপরেও যেখন যতটুকু কর্মসংস্থানের শিকে ছিঁড়ছে। তার সিংহভাগের প্রথম দাবিদার অবাঙালিরা। বাঙালির ছেলেমেয়েরা বাংলায় চাকরি পাবে না। চাকরি থাকলে তা আগে পাবে অবাঙালিদের ছেলেমেয়েরাই। তাহলে বাঙালির ছেলেমেয়েরা করবেটা কি? কেন, তারা বাঙালির সব পূজোপার্বণ পালন করে অবাঙালিদের পুজোপার্বনও ঘটা করে পালন করবে। চাঁদাবাজির হাত ধরে পকেট খরচ যদি চলে যায়, ভাবনা কি? তারপর ক্লাবে ক্লাবে অনুদান রয়েছে। সেখান থেকেও হাতখরচের একটা বন্দোবস্ত। এতেও যাঁদের প্রয়োজন মিটবে না। তাদের জন্য সিন্ডিকেট ব্যবস্থাও কায়েম রয়েছে। নেতাদের মিছিলে ভিড় জোগার করে দিতে পারলেও মোটামুটি আমদানী মন্দ নয় হয়তো। ফলে সোজা পথে বাঁকা পথে রোজগারের পথ বন্ধ নেই কিন্তু। থাকলে অন্তত রাজ্যের রাজনৈতিক স্ট্রাকচার বদলিয়ে যেত। প্রশ্ন এখন একটাই। কতদিন সামাল দেওয়া যাবে এইভাবে আর? আমরা জানি না নতুন কিছু তুরুপের তাস রয়েছে কিনা দুই সরকার কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির হাতে।
২৫শে জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত