না- ভোটের ফল বেড়িয়ে যাওয়ার পর তাঁকে আর ময়দানে দেখা যায়নি। তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর তরুণ বয়সের স্বপ্নের কথা। যখন দেশের জন্য, দশের জন্য কিছু একটা করার বড়ো বাসনা ছিল তাঁর। কিন্তু তখন তাঁর সামনে হয়তো অনুসরণ যোগ্য সেরকম উপযুক্ত কোন নেতা ছিলেন না। যাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনসেবা দেশসেবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন। ফলে তাঁর সেই তরুণ বয়সে তাঁর পক্ষে আর জনসেবা দেশসেবার কাজে নিজেকে সমর্পণ করা সম্ভব হয়েছিল না। যে দুঃখ তাঁকে আজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে নিশ্চিত করেই। কিন্তু তাসত্ত্বেও তখন জনগণের অবসর মুহুর্তকে বিনোদন মুখর করে তুলতেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বোম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতে। জনসেবা দেশসেবা না হোক, মানুষের মনে নির্ভেজাল আনন্দ দিয়ে বহু মানুষের বহু তরুণ তরুণীর নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। স্টার থেকে মেগাস্টার। সেসময়ে তাঁর স্টাইলে চুলের ছাঁট, তাঁর ভঙ্গিমায় কথা বলা। তাঁর কায়দায় হাঁটাচলা করতে দেখা যেত বহু উঠতি বয়সের ছেলেকে। সেইসব তরুণের স্বপ্নে তিনি ছিলেন মহাগুরু। বহু তরুণীর হার্টথ্রব। সেই তিনিই যখন জীবনসায়াহ্নের দ্বারে উপনীত হয়ে ভরা জনসভায় জানিয়ে দেন তাঁর সেই তরুণ বয়সের অপূর্ণ স্বপ্নের কথা। সেই জনসেবা সেই দেশসেবা করার আজীবনের আর্তি। প্রকৃত অনুসরণ যোগ্য নেতার অভাবে যে কাজে এতদিন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন নি। সেই তিনিই যখন জানিয়ে দেন, অবশেষে এত বছর বয়সে এসে তিনি সেই অনুসরণ যোগ্য একজন মহানেতার দেখা পেয়ে গিয়েছেন। তাই আর বসে থাকা নয়। তাই আর কালক্ষেপ নয়। যাঁর কর্মে উৎসাহিত হয়ে তিনি সেই মহানেতার দলে যোগ দিচ্ছেন, শুধুমাত্র এই বাংলার জন্য কিছু করতে চান বলে। তখন বাঙালি মাত্রেই আমারাও নড়ে চড়ে বসে ছিলাম বইকি। মহাগুরু এবারে মহানেতার দেখা পেয়ে গিয়েছেন। আর কি চাই? এবার তিনি নিশ্চয় তাঁর জন্মভুমিতে ফিরে আসবেন। তাঁর রাজ্যের জন্য কিছু করবেন। কি করবেন সেটা পরিস্কার না বুঝতে পারলেও, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম তিনি এমন কিছু একটা করবেন। যার জন্য তাঁর কথামত বিশেষ একটি দলের হাতে গোটা রাজ্যটিকেই তুলে দেওয়া উচিৎ আমাদের। আমাদের মতো তাঁর অনেক ভক্তই তাঁর কথামত সেই বিশেষ রাজনৈতিক দলের হাতে নিজ রাজ্যকে তুলে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। ময়দানের সেই সভার উদ্যোক্তাদের মনেও নিশ্চয় সেরকমই হিসেব নিকেশ ছিল। তাই মহাগুরু আর মহানেতার সাক্ষাতের সেই মহাজনসভায় কত ভীড় হয়েছিল, সেই নিয়ে মিডিয়া জুড়ে প্রচারও কম হয়নি।
কিন্তু না। ভোটের ফলাফলে সেই ভিড়ের প্রতিফলন তেমনটি ফললো কই? যেমনটি মাস তিনেক ধরে জনসভা রোডশো টকশো থেকে টিভির প্রচারে খবরের কাগজে দাবি করা হচ্ছিল। রাজ্যবাসীর ৪৮% শতাংশ মানুষ কংগ্রেস ও বামফ্রন্টকে বিধানসভায় শূন্য করে দিয়ে সেই দলের হাতে রাজ্যকে তুলে দেওয়া রুখে দিল। কারণ তাঁরা জানতো মহাগুরুর স্বপ্নের দলের হাতে রাজ্যকে তুলে দেওয়ার জন্য একশ্রেণীর মানুষ মুখিয়েই রয়েছে। তাঁদেরকে ব্যর্থ করতে হলে প্রয়োজনে বাম কংগ্রেসকে বিধানসভায় শূন্য করে দিতে হলেও, সেটাই করতে হবে। এবং তাঁরা ঠিক সেটাই করেছেন। ফলে বিফলে গিয়েছে রাজ্যকে সেই গোবলয়ের হাতে তুলে দেওয়ার স্বপ্ন। বিফলে গিয়েছে মহাগুরুর আবেদন। সফল হতে পারলো না মহাগুরুর তরুণ বয়সের সেই অপূর্ণ সাধ। রাজ্যের জন্য রাজ্যবাসীর জন্য কিছু একটা করার বাসনা। তারপর তাঁকে আর দেখা গেল না রাজ্যের ধারে কাছে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল না, আর এক বড়ো অভিনেতাকেও। প্রায় চার দশক আগে যিনি তাঁর সময়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভিক্ট্রি সাইন দেখিয়ে সেই একই গোবলয়ের দলের সদস্য হয়ে। কিন্তু নির্বাচনে ভিক্ট্রির বদলে পরাজিত হওয়ার পর থেকে, তাঁকেও আর কখনো জনতার পাশে দেখা যায়নি। তাঁরও বড়ো সখ ছিল কলকাতার জন্য, কলকাতাবাসীর জন্য কিছু একটা করার। মহাগুরুও বড় মুখ করে তাঁর আজীবন সেই সখের কথা জানিয়েছিলেন। ভরা জনসভায়। সেই উঠতি বয়সের তরুণের স্বপ্নের কথা। রাজ্যের জন্য রাজ্যবাসীর জন্য কিছু একটা করার। কিন্তু তিনি তো আর ভোটে দাঁড়াননি। তাঁর দল নির্বাচনে পরাজিত হয়ে গেলেও তিনি তো আর পরাজিত হননি। তাঁর তবে মুখ লুকানোর মতো কি ঘটলো? নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হলেও না হয় বোঝা যেত। জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। না, তিনি অন্তত সেকথা বলতে পারবেন না। কে বলতে পারে, যে ৩৮% ভোটার তাঁর দলের হাতে রাজ্যকে তুলে দিতে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের একটা বড়ো অংশই তাঁর কথায় প্রভাবিত হন নি? কারণ ৩৮% জনসমর্থন রাজনীতির ময়দানে হেলেফেলার বিষয় নয় আদৌ। তাহলে? কেন তাঁকে আর দেখা গেল না? বিশেষ করে মানুষ যখন একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডারের জন্যে হন্যে হয় ঘুরপাক খাচ্ছিল? কেন তাঁর কোন বাণী শোনা গেল না আর, প্রতিদিন পটপট করে একদল করোনাগ্রস্ত রাজ্যবাসী যখন ঝরে পড়ছিলো জীবন থেকে? তিনি তো এক ছোবলেই ছবি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। রাজ্যজুড়ে করোনার দাপটের সময় তাঁর সেই বিখ্যাত ফণা গুটিয়ে রইল কেন? ইয়াসের তাণ্ডবে বিদ্ধস্ত জনজীবনের জন্যেও কি, কিছু একটা করার মতো কোন কাজ খুঁজে পেলেন না তিনি? না, তিনি তখন বেমালুল হাওয়া। রাজ্যের জন্য রাজ্যবাসীর জন্য তিনি ঠিক কি করতে চেয়েছিলেন। জানা হলো না আর আমাদের। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, ইয়াসের তাণ্ডবেও যখন তিনি কিছু একটা করার মতো কোন কিছুই খুঁজে পেলেন না। তখন মহাগুরুর মেকআপের অনেকটাই হয়তো স্পষ্ট হয়ে ওঠার কথা। অন্তত রাজ্যবাসীর কাছে। মহাগুরুদের মেকআপ এইভাবেই সময় অসময়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আশির দশকের এলাহবাদেও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল নাকি?
১৮ই জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত