পশ্চিমবঙ্গে ঘুষ না দিলে রাজ্যসরকারের দপ্তরে চাকরি মেলে না সহজে। ইন্টারভিউয়ে পাশ করলেই হবে না। দাবি মতো ঘুষ দিলে তবে মিলবে চাকরি। এমনই একটি ধারণা প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকারের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই চিত্রটা একইরকম বলেই শোনা যায়। তার সাথে আরও একটি কথা হাওয়া ভাসে। শাসকদলের কেষ্টবিষ্টুদের হাতে টাকা গুঁজে দিলে সরকারী চাকরি পেতে অসুবিধে হয় না। উপযুক্ত যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক। বিষয়টি এমন নয়, যোগ্যতা থাকলে কোন টাকা লাগবে না। বা যোগ্যতা না থাকলে তবেই টাকা লাগবে। বিষয়টা নাকি আসলে, রাজ্যের অধীনস্ত সরকারী দপ্তর কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলিতে চাকরি পেতে গেলে, ‘ফেল কড়ি মাখো তেল। এখন তেল মাখার প্রার্থীর কোন অভাব নেই। প্রার্থীর তুলনায় চাকরিতে শূন্যপদ বহুগুন কম। ফলে চাকরির হাহাকার যত বেশি। টাকার মূল্যও তত বেশি। এবং ঘুষের দাবিও ততই ওপেন সিক্রেট। চাকরি পাওয়া ও দেওয়ার এই চিত্র একেবারে পঞ্চায়েতস্তর অব্দি বিস্তৃত। সাম্প্রতিক টেট কেলেঙ্কারি নিয়ে উদ্ভুত বিতর্কে এমন খবরও হাওয়ায় ভাসছে, যেখানে চাকরির লিখিত পরীক্ষায় চাকুরি প্রার্থী হাসতে হাসতে শাদা খাতা জমা দিয়েও সফল প্রার্থীয় তালিকায় নিজের নাম সংযুক্ত করে ফেলেছে। এই যে একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। সরকারী চাকরিকে কেন্দ্র করে। যে কোন সমাজে তার প্রভাব কিন্তু মারাত্মক রকমের ভয়াবহ। ঘুষের টাকায় বিনা যোগ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে পড়ার এই ধারা যদি দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। তবে গোটা সমাজটাই হাতুরেদের অধিকারে চলে যাবে একদিন। একটা গোটা সমাজের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা এইভাবে হাতুরেদের হাতে চলে গেলে সমাজের প্রত্যেকেরই জীবন বিপন্ন হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। না, এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটুকু অনুধাবন করার ক্ষমতা হয়তো আজ আর কারুরই নেই। যাদের হাতে চাকরি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারা শুধু হিসেব কষে যাচ্ছে কত টাকা বেশি আমদানী হলো। আর যাদের একটি চাকরির খুব দরকার। তারা প্রয়োজনে ঘটিবাটি বেচেও একটি চাকরি পেয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। তারপর সেই চাকরির দায় ও দায়িত্ব অধিকার ও কর্তব্যের দিকগুলির দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কোন দরকারও তারা অনুভব করতে পারছে না। ব্যক্তিমানসের পচন দিনে দিনে সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার সমাজিক সেই পচন বাকি জনমানসেও পচন ধরিয়ে দিচ্ছে।
এই চক্রের ভিতর দিয়েই বেড়ে উঠছে বাঙালির কিশোর কিশোরী। তরুন তরুনী। যাদের সামনে আমরা একটা জমাট অন্ধকার তৈরী করে রেখে দিয়েছি। যে অন্ধকার ভেদ করে পথ করে নিতে গেলে, ঘুষ আর ঘুষিই একমাত্র উপায়। না, এই অবস্থা মাত্র এক দশকেই গড়ে ওঠেনি। এক দশকে অবস্থা সবচেয়ে বেশি ঘোরালো এবং সর্বাত্মক হয়েছে শুধু। শুধুমাত্র কোন একটি রাজনৈতিক দলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলেই অবস্থা সামলানো যাবে না। অবস্থা সামলাতে গেলে বাংলার সমাজ ও রাজনীতির গভীরে গিয়ে পৌছাতে হবে। বাঙালি জাতির অন্যতম বড়ো অসুখ ‘ফাঁকিবাজি’। আমরা কষ্ট ও সাধনার বিকল্প হিসেবে এই ফাঁকিবাজিকেই স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছি। আমরা দেশ ও সমাজ গড়ার বিকল্প হিসেবে নিজের আখের গোছানোকেই স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছি। আমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বিকল্প হিসেবে দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি। আমরা চোর ধরার বিকল্প হিসেবে চুরিতেই উৎসাহ দিয়ে এসেছি। ফলে, আজকের অভিভাবকরা আপন সন্তানের একটি চাকরি পাওয়ার জন্য সব রকমের দুর্নীতিতে মদত দিয়ে চলেছেন। প্রতিদিনই শোনা যায়, অমুকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রতারণা করেছে। আমরাও সেই প্রতারকের মুণ্ডুপাত করতে টিভির সামনে বসে যাই। কিন্তু আমরা কেউ একবার সেই অভিভাবক কিংবা চাকুরি প্রার্থীর দিকে আঙুল তুলি না। সরকারী চাকরি পেতে কেন তারা লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারকের হাতে তুলে দেন? প্রশ্ন করি না কেউ। কারণ আমরা প্রত্যেকেই জানি। কাল আমার সন্তানের জন্য আমকেও সেই একই কাজ করতে হবে। আমিও সন্তানের সরকারী চাকরি পাওয়া নিশ্চিত করতে পিছনের দরজায় কড়া নাড়তে দরকারে ঘটিবাটি বেচেও ঘুষের টাকা জোগার করবো। কিংবা ইতিমধ্যেই সেই কাজ সাফল্যের সাথে করে ফেলেছি আমি, আপনি। ফলে আমাদের যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটি না রেখে টাকা আত্মসাৎ করা প্রতারকের উপরেই। যেন সেই একই প্রতারক টাকা নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে চাকরি পাইয়ে দিলে আর কোন দোষের ভাগীদার হতো না। এতটাই পচন ধরে গিয়েছে আমাদের জীবনে। আমাদের জীবন যাপনের পরতে পরতে। ফলে আমরা কেমন সুন্দরভাবে প্রতারক ও প্রাতারিতকে পৃথক করে ফেলি এই সকল ক্ষেত্রে। যেখানে পিছনের দরজা দিয়ে অন্যায় ভাবে কাজ হাসিলের উদ্দেশেই মানুষ প্রতারকের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। তারপরেও আমাদের চোখে প্রতারিত আর প্রতারক আলাদা বিচার পায়।
সমাজে প্রতারকেরা উপরে থেকে টুপ করে খসে পড়ে না। সমাজই প্রতারকদের জন্ম দেয়। সমাজের ভিতরেই প্রতারণার সংস্কৃতি যখন অধিকাংশ মানুষকে গ্রাস করে নেয়, তখনই প্রতারিতরা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যায়। যেখানে প্রতারক আর প্রতারিত দুইয়ের ভিতর স্বভাবের পার্থক্য প্রায় শূন্য। ঠিক এই কারণেই চুড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে দাঙ্গাবাজ মন্ত্রীদেরকেও আমরা দিনের পর দিন ভোট দিয়ে যেতে থাকি নির্বিচারে। তাঁদের রোডশোতে তাঁদের নামে জয়ধ্বনি দিতেও আমদের কোন লজ্জাবোধ হয় না। বরং প্রয়াস থাকে তাঁদের চ্যালাচামুণ্ডাদের একটু নেক নজরে পড়ার। তাহলেই যেকোন দুর্নীতির সুফল ঘরে তুলতে পারা যাবে। সার্বিক ভাবে একটা সমাজের অধিকাংশ মানুষের এই যেখানে মনোবৃত্তি। সেখানে প্রতারক আর প্রতারিতের ভিতরে পার্থক্য কতটা সূক্ষ্ম, সেটি খালি চোখে ঠাওর করা দায়। এই সূক্ষ্ম প্রভেদই আজকের পরিস্থিরি পিছনে মূল অনুঘটক। না, সেকথা আমরা বুঝতে যাবোও না। বুঝতে চাইবোও না।
১৭ই জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত