কবি শামসুর রহমানের একটি কবিতার নাম, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। জানি না কবি যখন কবিতাটি লিখছিলেন। সেই সময়ে তাঁর কোন ধারণা ছিল কিনা, বাঙালি নিজেই সেই দুঃখিনী বর্ণমালাকে সজ্ঞানে বর্জন করার নানান পথ ও উপায়, যুক্তি ও অজুহাত খুঁজে নেবে। কাঁটাতারের উভয় পারেই। সমান উদ্যমে। আপনি ঢাকা কিংবা কলকাতা। যেখানেই যান। কম বেশি সবখানেই দেখবেন পথের দুধারে দুঃখিনী বর্ণমালার দুঃখজনক অনুপস্থিতি। হ্যাঁ, রাষ্ট্রীয় কারণে ঢাকা বা বাংলাদেশে দুঃখিনী বর্ণমালার তবু সকরুণ উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু কলকাতা কিংবা পশ্চিমবঙ্গে দুঃখিনী বর্ণমালা বিদেশী ইংরেজি ও হিন্দুস্তানী হিন্দী এমনকি পাকিস্তানী উর্দুর কাছেও মার খেতে খেতে প্রায় অমেরুদণ্ডী প্রাণী কেঁচোর মতো কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে রয়েছে এককোণে। সৌজন্যে আমরা বাঙালি। টলমল পায়ে শিশুর মুখে প্রথম বোল ফোটার আগে থেকেই আমরা শিশুকে তার আইজ, নোজ, হ্যাণ্ড, লেগ, বেলি ও হেডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকি। তারপর ইংলিশ আলফাবেটের সাথে পরিচয়ের সুত্রে হাতেখড়িও হয়ে যায় বাঙালি শিশুর। আমাদের যুক্তি খুব পরিস্কার। শিক্ষাদীক্ষা অর্জনের ভাষা ইংরেজি। বিশ্বায়নের ভাষা ইংরেজি। ভারতীয় সংবিধান সম্বন্ধে একবর্ণ জ্ঞান না থাকায় আমরা জেনে গিয়েছি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দী। ব্যাবসা বাণিজ্য অর্থনীতির ভাষা ইংরেজি ও হিন্দী। চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি গবেষণা উচ্চশিক্ষা প্রভৃতির ভাষা ইংরেজি। ধন উপার্জনের ভাষা ইংরেজি ও হিন্দী। সমাজে সম্মানজনক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার ভাষা ইংরেজি। ইনটারনেট সহ বাকি বিশ্বের সাথে সংযোগের ভাষা ইংরেজি। ফলে সমৃদ্ধি ও সংযোগ। মানুষের জীবনে এই দুইটির প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের হেডে বদ্ধমূল এক ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছি আমরা, বাংলা আর যাই হোক সমৃদ্ধি ও সংযোগের ভাষা নয়। বাংলা বিচ্ছিন্নতার ভাষা। বাংলা পিছিয়ে পড়ার ভাষা। জ্ঞান ও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের চর্চা বাংলাভাষায় সম্ভব নয়। ফলে বাংলা বর্ণমালার অস্তিত্বের গুরুত্বও শূন্য প্রায়। প্রায়, তার কারণ একটাই। সংস্কৃতিচর্চার দিগন্তে নামডাক অর্জন করতেই যা একটু অ আ ক খ নিয়ে টানাটানির দরকার হয়ে পড়ে। তা না হলে কে আর ঐমুখো হয়।
না, তাই আমরা বাঙালিরা যে যতখানি শিক্ষিত। সে ততখানি পরিমাণেই বাংলা বর্ণমালাকে নিজেদের জীবনে অপ্রাসঙ্গিক এবং নিষ্কর্মা করে রেখে দিয়েছি। এই একটি বিষয়। যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে কাজে লাগে না বিশেষ। তাতে আমাদের না আছে লজ্জা। না আছে শোক। কোন রকম আফশোসও নেই। কোনরকম হাহাকারও নেই। বরং দুঃখিনী বর্ণমালা থেকে প্রতিদিন যত দূরে থাকা যায়। ততটাই আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। আমরা মনে করি, দুঃখিনী বর্ণমালা নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। বাংলার মতো একটি পশ্চাৎপদ ভাষার বৃত্তে পড়ে থাকার ভিতরেই বরং চরম লজ্জা রয়েছে। ঠিক এমনটাই মনে করে থাকি আমরা। স্বয়ং রবি ঠাকুরই কি বলেননি, হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি? রবীন্দ্রনাথ আউরিয়েই তো আমরা আত্মপক্ষ সমর্থনের ঘুঁটি সাজাই। বাঙালি হিসেবে পিছিয়ে পড়ে থাকতে কে চায়? আমরা কি মানুষ হয়ে উঠতে চাইবো না? দুঃখিনী বর্ণমালা নিয়ে পড়ে থাকার গ্লানি কে সহ্য করবে? তাই মানুষ হয়ে ওঠার ভাষা ইংরেজি আর হিন্দীতেই আমাদের মন দিতে হবে। সেই পথেই তো এগিয়ে চলেছে স্বদেশ। কাঁটাতারের দুই পারে। যে যত বেশি বেগে এগোবে। সেই তত দ্রুত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। ফলে আজ আমাদের দুই বাংলার ভিতরেই এক অলিখিত প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গিয়েছে। কে কাকে কতটা আগে কতটা বেশি ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। ঠিক এই কারণেই আমরা সন্তানের জন্ম সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্র ভালো ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলে ভর্তির করার কথা ভাবতে শুরু করে দিই। সেই মতো পরিকল্পনাও সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে থাকি। আমাদের সন্তানকে তো আর বাঙালি করে ফেলে রাখতে পারি না আমরা। তাদেরকে মানুষ করে যেতে হবে। আর বাঙালির পক্ষে আপন বর্ণমালাকে বর্জন না করে মানুষ হয়ে ওঠার উপায়ই বা কই? তাই দুঃখিনী বর্ণমালার জন্য দুঃখ করা আর নিজের পায়ে কুড়ুল মারা, দুই এক। বুদ্ধিমান বাঙালি সেই কাজ করতে পারে না কখোনই।
যে বর্ণমালায় রোগের উপশম হয় না। ওষুধ প্রস্তুত করা যায় না। মানুষকে বাঁচানো যায় না। সেই বর্ণমালায় বাঙালির কি এসে যায়? যে বর্ণমালায় নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয় না। অস্ত্রশস্ত্র তৈরী করা যায় না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায় না। সেই বর্ণমালায় বাঙালির কি এসে যায়? যে বর্ণমালায় বাকি বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করা যায় না। সকলের সাথে এবং সকল কিছুর সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায় না। সেই বর্ণমালায় বাঙালির কি এসে যায়? যে বর্ণমালাকে বিশ্বে কোন জাতিই এতটুকু পাত্তা দেয় না, সেই বর্ণমালায় বাঙালির কি এসে যায়? না, সেই বর্ণমালাকে নিয়ে পড়ে থাকার মতো সময় ও আবেগ, নির্বুদ্ধিতা ও হটকারিতা বাঙালির ভিতরেও নেই। কোনদিনই কি ছিল? মনে হয় না বিশেষ। তাই তো বাঙালি চিরকালই, যখন যে সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেছে। তখন সেই সাম্রাজ্যের বর্ণমালাকেই আপন করে নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। এটা জাতি হিসাবে বাঙালির সবচেয়ে বড়ো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। অর্থাৎ বশ্যতা স্বীকারের পথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বর্ণমালাকে নিয়েই বাঙালি মাথায় তুলে নাচতে ভালোবাসে। হাজার বছরের বেশি সময়ের বাঙালির ইতিহাসের অভিমুখ এইদিকেই এগিয়ে চলেছে। কখনো ধীর গতিতে। কখনো দুর্বার গতিতে। সাম্রাজ্যবাদের বর্ণমালাকে আপন করে নিতেই বাঙালির যাবতীয় উদ্যোগ ও আবেগ। সাধ ও সাধনা। প্রয়োজন ও প্রয়াস। এই বিষয়ে সচেতনতা অর্জনই বাঙালির জীবনে শিক্ষিত হয়ে ওঠার প্রধান প্রমাণ। সেই বাঙালিই শিক্ষিত, যে বাঙালি সাম্রাজ্যবাদী বর্ণমালাকে জীবনের পাথেয় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি বাঙালিকে শিক্ষিত বলা যায় কি? আবার বাংলার জনসমাজে, যে বাঙালি যত সফল ভাবে সাম্রাজ্যবাদী বর্ণমালায় জীবন গড়ে নিতে পেরেছে, সেই’ ই তত সামাজিক ভাবে পূজনীয় এবং মান্যগণ্য। ফলে কবির দুঃখিনী বর্ণমালা যতটা না দুঃখিনী। তার থেকে অনেক বেশি অপ্রয়োজনীয়। বাজে জিনিসের ঝুড়িতে ফেলে রাখার মতো তার অবস্থা আজ। কারণ বাঙালি যে মানুষ হয়ে উঠতে চেয়েছে। তাকে যে মানুষ হয়ে উঠতে হবে। বাঙালি হয়ে থাকলে বাঙালির দিন চলবে কি করে?
৮ই জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত