কথায় বলে চোখ বন্ধ থাকলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না। সরকার ক্রমান্বয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ কমাতে কমাতে, শিক্ষাকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি বিলাস সামগ্রীর পর্যায় নিয়ে যেতে চলেছে। আর এই পরিকল্পনা যথেষ্ঠই সাফল্যের মুখ দেখে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। এবং এরই পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির সাথে সাথেই শিক্ষা বিপুল মুনাফা লাভের এক লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এবং সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থই শিক্ষার গতি এবং প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেও দিয়েছে। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। অন্যান্য রাজ্যের ভিতরে কেরলা এবং দিল্লীতে একটা বিকল্প প্রয়াস চলছে। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অধিকতর কার্যকর করে তুলে বেশি করে সরকারী ভর্তুকি দিয়ে এমন একটি অবস্থায় তুলে আনার প্রয়াস চলছে, যাতে অধিকতর শিক্ষার্থী সরকারী প্রতিষ্ঠানমুখী হতে পারে। কিন্তু আমাদের বাংলায় অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। আমাদের নজর রাজ্যরাজনীতির ঘোরপ্যাঁচের ভিতরে এমন ভাবেই আটকিয়ে থাকে। আমরা এই দিকগুলিতে বিশেষ করে নজর দেওয়ার সময় পাই না। অধিকাংশ অভিভাবকদেরই লক্ষ্য থাকে সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভরতি করে দেওয়া। তার জন্যে অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনেও তাঁরা রাজি। ফলে স্বচ্ছল এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের একটা বড়ো অংশই ধনী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মতোই বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভিড় করছে বেশি করে। আর সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অধিকাংশই মেধাবী শিক্ষার্থীদের অভাবে, এবং উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে আরও এক বড়ো সমস্যা। অধিকাংশ সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘ দিন ধরে বহু শূন্যপদ খালি পড়ে রয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না সময় মতো। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে প্রায়। আবার অনেক স্কুলে ছাত্রের অভাবেও স্কুল বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ – ১৩ সালের পর থেকে বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে রয়েছে। তার কারণ অর্থাভাব নয়। কারণ সদিচ্ছার অভাব। স্কুলে স্কুলে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য রাজ্যব্যাপী এক মহা সংকট দেখা দিয়েছে। দিয়েছে কারণ শিক্ষক নিয়োগের কর্ম পদ্ধতির ভিতরে দুর্নীতির রামরাজত্বের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। ২০১৫ সালে গৃহীত শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা থেকে এখন অব্দি সময় সীমায় শিক্ষক নিয়োগ শুরুই হয় নি। বছরের পর বছর সেই নিয়োগ থমকে রয়েছে। মামলা চলছে আদালতে একের পর এক। দুর্নীতির ভিতর দিয়ে চুড়ান্ত অব্যবস্থার ভিতর দিয়ে চলছে শিক্ষক নিয়োগের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। লিখিত পরীক্ষায় সাদা উত্তরপত্র জমা দেওয়ার পরেও সেই প্রার্থীর নাম থাকছে নাকি চুড়ান্ত মেরিট লিস্টে। আর ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়েও একাধিক চাকুরি প্রার্থীর নাম বাদ পড়ে যাচ্ছে সফল প্রার্থীর তালিকা থেকে। একটি শিক্ষকপদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য নাকি দশ পনেরো বিশ লক্ষ টাকা অব্দি ঘুষ দিতে হচ্ছে। ফলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যায় করে যারা নিয়োগ পরীক্ষায় বসেন, স্বভাবতই তাদের পক্ষে সাদা খাতা জমা দেওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়। সবচেয়ে বড়ো সর্বনাশের বিষয় হচ্ছে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন করাই হচ্ছে না। পিছনের দরজা দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মেরিট লিস্টে নাম উঠে যাচ্ছে। এই ভাবে অযোগ্যদের হাতে শিক্ষার্থীদের ভার পড়লে। একটা গোটা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে সন্দেহ নাই। বস্তুত রাজ্যে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে বহু দিন ধরেই অযোগ্য প্রার্থীরাও সুযোগ পেয়ে আসছেন। হ্যাঁ বিগত সরকারের আমল থেকেই এই ধারা চলে এসেছে। বর্তমান সরকারের আমলে গোটা ব্যবস্থাটিই কার্যত প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে বলা যেতে পারে। একদিকে অযোগ্য প্রার্থীরা নগদ অর্থের বিনিময়ে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মাথা পিছু দশ থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা ঘুষ আদায়ের পদ্ধতিতে কালোটাকার এক বিশালচক্র কাজ করে চলেছে রমরমিয়ে। ফলে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কার্যত এক দুষ্টচক্রের হাতে গিয়ে পড়েছে। তারাই হর্তা কর্তা বিধাতা। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও স্বার্থের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা ব্যবস্থাটি। এর ফলে যুবসম্প্রদায়ের একটা বড়ো অংশই, যারা মেধার সাহায্যে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পা রাখতে চেয়েছে। তারা বঞ্চিত হয়ে বেকার জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। অপর দিকে সম্পূর্ণ মেধাহীন একটি প্রজন্ম সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে ঢুকে যেতে পারছে। পরবর্তী সময়ে যাদের হাতে রাজ্যের কচিকাঁচাদের মেধাই ধর্ষিত হতে বাধ্য। একটা জাতির জীবনে এর থেকে বড়ো দুর্দিন। এর থেকে বড়ো ঘোর সংকট আর কি হতে পারে। যুদ্ধ করে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার ভিতরে দুর্নীতির ঘূনপোকা ঢুকিয়ে দিয়ে একটা জাতির মেরুদণ্ডকেই বিকলাঙ্গ করে দেওয়া যায় সহজেই। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ঠিক সেই কাণ্ডই হয়ে চলেছে। সরকার ও তার প্রশাসন এবং রাজ্য রাজনীতির সৌজন্যেই। এবং এই বিষয়ে কেন্দ্র সরকারের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতারও কোন অভাব রয়েছে বলে মনে হয় না। তারা সারা ভারতব্যাপী যে সর্বনাশের আয়োজন করতে চেয়েছেন। রাজ্যে সেই আয়োজন ইতিমধ্যেই বিপুল সাফল্যের সাথেই পরিচালিত করার প্রয়াস চলছে। এবং চলতেও থাকবে।
৭ই জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত