দিল্লীর সীমান্তে অবস্থানরত কৃষক আন্দোলনের আজ সাত মাস পূর্ণ হলো। অন্ধভক্তদের কথা থাক। তার বাইরেও অনেক মানুষই চলতি কৃষক আন্দোলন তার ধার হারিয়ে দিশাহারা। এমনটাই ধারণা করে নিচ্ছেন। সৌজন্যে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলি। সরকারের ভেঁপু বাজাতেই যাদের বেশির ভাগ সময়টা ব্যায় হয়ে যায়। বাকিটা সত্যকে ধামাচাপা দিতে। ফলে সাধারণ জনতার হাতে বিশেষ কোন বিকল্প থাকে না সত্যে উদ্ধারের। কিন্তু তাই বলে আন্দোলনরত কৃষকরা বসে নেই কিন্তু। বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্দোলনের প্রাণভোমরা আজও কিন্তু তাদেরই হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে। বহু চেষ্টা করেও। বিস্তর পরিকল্পনা ষড়যন্ত্র করেও রাষ্ট্র কিন্তু সেই প্রাণভোমরা হাতিয়ে নিতে পারেনি কৃষকদের কাছ থেকে। আর সেই কারণেই রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দিল্লীর সীমান্তেই কৃষক আন্দোলনকে আটকিয়ে রাখতে চাইছে। চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং রাষ্ট্রের পরিচালনায় থাকা শাসকদলও জানে। তাদের হাত থেকে পাঞ্জাব হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক দখলদারির ভবিষ্যত চলে গিয়েছে কৃষকদের হাতে। এই অঞ্চলটি যে তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। এই বিষয়ে তাদের ভিতরেও আজ আর কোন সংশয় নেই। ফলে তাদের সকল নজর এখন বাকি ভারতের দিকে। দিল্লীর সীমান্তে অবস্থানরত শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন যাতে বাকি ভারতে এই মাত্রায় সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে না পড়ে। দেশজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় তারা এতটা চিন্তিত নয়। যতটা চিন্তিত কৃষক আন্দোলনকে পাঞ্জাব হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ভিতরে সীমাবদ্ধ করে ঠেকিয়ে রাখতে। এর বাইরে এই আন্দোলন যত ছড়িয়ে পড়বে। গদি হারানোর দিনও তত কাছে এগিয়ে আসতে থাকবে। এই সহজ কথাটি কেন্দ্র সরকার খুব ভালো করেই টের পেয়ে গিয়েছে। তাই তারাও খুব একটা নিশ্চিন্তে স্বস্তিতে গদিতে বসে নেই কিন্তু। এই রকম একটি অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে গেলে। তাদের হাতে সবচেয়ে বড়ো তুরুপের তাস কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়কে তুলে ধরে জাতীয়তাবাদের আবেগকে উস্কিয়ে দেওয়া। পুলওয়ামা কাণ্ডে যে তাসের সুনিপুণ ব্যবহারে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো করে কেল্লাফতে করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সেই তাস যখন তখন যত্রতত্র ব্যবহার করলে তার ধার ও ভার এবং কার্যকারিতা সবই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে, সরকারের পক্ষে এই মুহুর্তেই সেই তাস ব্যবহার করা সম্ভব নয়। বিশাল একটা ঝুঁকি না নিলে। এবং সামনে যেহেতু আরও তিনটি বছর বাকি। পরবর্তী নির্বাচনের। সেই কারণেই সরকারকেও এখন ধীরে চলো নীতি নিতে হচ্ছে।
আন্দোলনরত কৃষকরাও সেই বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলেই অনুমান। যে কারণে তাঁরাও একটা কথাই বারংবার বলে চলেছে। সাত মাস হয়ে গিয়েছে তো কি হয়েছে। এতো মাত্র কয়েকটি দিন গেল আন্দোলনের। এখনো তিন বছর এই আন্দোলন চলবে। যতক্ষণ না নতুন কৃষি আইন বাতিল হচ্ছে। এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা হচ্ছে প্রধান প্রধান শস্যের জন্যে। ফলে সাত মাস অতিক্রান্ত হলেও আন্দোলন আজও সফল হচ্ছে না মনে করে কৃষকদের মনোবল ভাঙতে শুরু করেছে। এমন কোন প্রচারের আসলেই কোন সত্যতা নেই। সত্যতা যে নেই। সেকথা পাঞ্জাব হরিয়ানা পশ্চিম উত্তরপ্রেদেশর যে কোন গ্রামে গেলেই টের পাওয়া যাবে। টের পাওয়া যাবে দিল্লীর সীমানায় টিকরি সিংঘু কিংবা গাজিপুর বর্ডারে গেলেও। হাজার হাজার কৃষক সাত মাস ধরে পালা করে দিল্লীর সীমানায় রাজপথে পড়ে রয়েছে। যার ভিতরে প্রায় ছয়শো জন শহীদ হয়েছেন। এবং লক্ষ লক্ষ কেন কোটি কোটি কৃষক পাঞ্জাব হরিয়ানা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ সহ অন্যান্য অঞ্চল থেকেও আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে তাদের জন্য নিরন্তর খাদ্য সরবরাহ করে চলেছেন যে আন্দোলনে। সেই আন্দোলনকে এতটা হালকা ভাবে নেওয়ারও আর কোন উপায় নাই। দিল্লীর সীমান্তে রাজপথে অবস্থানরত কৃষকদের এই আন্দোলন ভিতরে ভিতরে একটা গণআন্দোলনের রূপ নিয়ে ফেলছে ইতিমধ্যেই। আর সেটাই সরকার ও শাসক দলের মাথাব্যাথার মূল কারণ। না, তাই বলে তারা আইন বাতিলের কথা চিন্তাতেও ঠাঁই দেওয়ার পাত্র নয়। উল্টে, এই রূপ নিতে থাকা গণআন্দোলনকে কি করে দিগভ্রান্ত করে দেওয়া যায়। তাদের সকল পরিকল্পনা এখন সেই বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে মাস কয়েকের ব্যবধানে যেখানে পঞ্জাব উত্তরাখণ্ড উত্তরপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আছে। ফলে তাদের মূল মাথাব্যাথা কি করে এই আন্দোলনকে দিগভ্রান্ত করা যায়। তার জন্যে তারা আরও অপেক্ষায় রাজি। কারণ এখনো তাদের আশা। যত বেশিদিন এই আন্দোলনকে টানা যাবে। তত বেশি সহজ হবে এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করা। সেই আশায় ও লক্ষ্যে শান দিচ্ছে বর্তমান সরকার। এদিকে কৃষকরাও আন্দোলনের গতিপথকে পরিচালিত করতে চাইছে যেখানেই নির্বাচন, সেখানেই বর্তমান শাসকদলের নির্বাচনী ভরাডুবি নিশ্চিত করণের প্রয়াসে। ফলে তাদের ভিতর উদ্যোম উৎসাহ এবং দৃঢ়তার কোন ঘাটতির কোনরকম লক্ষ্মণও দেখা যাচ্ছে না। উল্টে, রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদেরকে কেন্দ্র সরকারের গদীতে আসীন শাসকদলের দেশবিরোধী নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। ফলে যুদ্ধ আদৌ থেমে নেই। কৃষকরা বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিতে রাজি নয়। যত দিন যাচ্ছে তারা আরও বেশি দৃঢ়তার সাথে জমাট বাঁধছে। লক্ষ্য তদের একটাই। দেশটাকে লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা করা। কারণ তাঁরা জানেন। আজ যদি তাঁরা দেশকে রক্ষা করতে না পারেন। তাহলে ইতিহাস কোনদিন তাঁদের ক্ষমা করবে না। ফলে নতুন তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত প্রতিটি কৃষকই আজ দেশরক্ষার প্রথম সারির সৈনিক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। বাকি ইতিহাসের নির্মাণ এখন মূলত তাঁদেরই হাতে।
২৬শে জুন’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত