না এখনই কোন লোকাল ট্রেন নয়। জানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। লোকাল ট্রেন চালু করলেই হু হু করে করোনা সংক্রমণ আরও বৃদ্ধি পাবে। এমনটাই তাঁর আশংকা। একটা বড়ো অংশের মানুষই মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সহমত হবেন। করোনা সংক্রমণ আরও অনেকটা না কমে আসা অব্দি যারা লকডাউন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপক্ষে। কিন্তু সেই সাথে সমাজের বৃহত্তর জনসাধারণ কিন্তু এই মুহুর্তেই লোকাল ট্রেন চালুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন। এবং তাঁদের এই দিন গুনতে থাকা কতটা সর্বাত্মক, সেটি দেখা গেল গতকাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন স্টেশনে লোকাল ট্রেন চালানোর দাবিতে রেল অবরোধের ঘটনায়। এই মানুষগুলির কেউই কিন্তু ট্রেনে চড়ে হাওয়া খেতে লোকালে চাপেন না। কিংবা কোলকাতায় বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও শিয়ালদহগামী লোকালে ওঠেন না। দুই চব্বিশ পরগণা সহ কলকাতা সংলগ্ন শহরতলী জুড়ে একাধিক জেলার মানুষের জীবন জীবীকা এই লোকাল ট্রেন নির্ভর। যারা সরকারী বেসরকারী সংস্থায় কাজ করেন। বাড়ি থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে যাতায়াতের জন্য তাদের অধিকাংশের কাছে লোকাল ট্রেনই এক মাত্র উপায়। কিন্তু শুধুই এই চাকুরী জীবীরাও নন। লোকাল ট্রেন না চললে হকার থেকে শুরু করে ব্যাবসাদার দোকানি ঠিকেলেবার পরিচারিকা ইত্যাদি বহু মানুষের জীবন জীবীকা স্তব্ধ। তাদের জীবন জীবিকা সচল রাখার একমাত্র উপায় এই লোকাল ট্রেন। যতদিন এই লোকাল ট্রেন ঠিকমত চলবে না। ততদিন তাঁদের জীবনও থমকে থাকবে। সঞ্চিত অর্থ ভাঙিয়ে আর কতদিন দুইবেলা আহার জুটবে? সকলেই যে নিয়মিত রেশন থেকে নিখরচায় চাল ডাল গম পাচ্ছেন তাও নয়। আবার শুধুই রেশনের চাল ডালেই সংসার চলার কথাও নয়। সংসারে হাজারো রকমের খরচ রয়েছে। কোথা থেকে সেই খরচের সংস্থান হবে?
ফলে মহামারীই হোক আর অতিমারী। সাধারণ থেকে সাধারণতর মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে যে লোকডাউন। তার পরিণাম কিন্তু মারাত্মক হতেই বাধ্য। গণ পরিবহন স্তব্ধ করে সংক্রমণ ঠেকানো কতটা সম্ভব সেটিও কিন্তু বিতর্কের উর্ধে নয়। তার হাতে গরম নমুনা আমরা গত বছরেই দেখেছি। মার্চের শেষ সপ্তাহে ভারতব্যাপী রেলের চাকা বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে সংক্রমণ কমার বদলে প্রতি মাসে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে পেতে মাঝ সেপটেম্বরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছিয়েছিল। গণ পরিবহন স্তব্ধ করলেই যে সংক্রমণ কমানো যাবে সেই তত্ত্ব যে নির্ভুল নয়। এই পরিসংখ্যানই তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়। তুলনামূলক ভাবে সংক্রমণ আরও অনেক বেশি ও ব্যাপক হতে পারতো যদি গণ পরিবহন চালু থাকতো। তবুও মানুষের জীবন জীবিকা স্তব্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই কোন। ফলে সংক্রমণ রোধ এবং জীবন জীবিকা সচল রাখার বিষয় দুইটিই একই সাথে কি করে এবং কতটা ভালো ভাবে সামলানো যায়। আসল পরীক্ষা কিন্তু সেইখানেই। আর এই পরীক্ষা দেওয়ার কথা কিন্তু জনগণের নয়। জনতার ভোটে নির্বাচিত সরকারের দায় এই পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করার। দুঃখের বিষয় লকডাউন করে, স্কুল কলেজ বন্ধ করে রেখে গণ পরিবহণ স্তব্ধ করে দিয়ে কল কারখানা ব্যাবসা বাণিজ্য বন্ধ করে রেখেও ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভবই হয় নি। কারণ জীবন বাঁচানের জন্যে এই পদক্ষেপগুলির থেকে অনেক বেশি জরুরী ছিল প্রতিটি সংক্রমিতের জন্য অক্সিজেন একটি হাসপাতালের বেড, আইসিউ, এবং ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে কেন্দ্র ও রাজ্য কোন সরকারই সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে নি। বা বলা ভালো সেই পথে এগোয়ই নি। তাই এত মৃত্যু। ফলে যাঁরা আশা করেন সংক্রমণ ঠেকাতে পারলেই মানুষের জীবন রক্ষা হবে। আর সংক্রমণ ঠেকানোর একটাই উপায়। গণ পরিবহন বন্ধ রেখে লকডাউন জারি রাখা। তারা স্বকল্পিত ধারণায় বাস্তব থেকে বহুদূরবর্তী অবস্থানে রয়ে গিয়েছেন। মহামারী অতিমারী হয়তো হঠাৎই এসেছে। কেউই প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু দেড় বছরও খুব একটা কম সময় নয়। আঠারো মাসে যাদের বছর হয় তাদের পক্ষেও। সেই আঠারো মাসে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া দরকার ছিল। সেগুলি ঠিক ঠিক মতো কার্যকর করতে পারলে জীবন জীবিকা গণ পরিবহণ স্তব্ধ না করেও করোনার বিরুদ্ধে অধিকতর সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল।
ফলে এই মুহুর্তে লোকাল ট্রেন চালু না করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্তের বদলে প্রয়োজন ছিল, যতটা সম্ভব বেশি সংখ্যাক লোকাল ট্রেন ঘন ঘন চালানো। এবং সকল ধরণের গণ পরিবহন যত বেশি করে ব্যবহার করা যেতে পারে, তা নিশ্চিত করা। তাহলে মানুষকে ঠাসাঠাসি করে গাদাগাদি করে চলাচল করতে হতো না। মুহুর্মুহ লোকাল ট্রেন পাতাল রেল বাস লঞ্চ অটো টোটো ট্যাক্সি ইত্যাদি চালু থাকলে মানুষ অধিকতর ফাঁকায় ফাঁকায় চলাচল করতে পারতো। যার ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে জীবন জীবিকার সমস্যার একটা সুরাহা হতে পারতো। সকল সরকারী দপ্তরে বিশেষ করে ব্যাংক পোস্ট অফিস কর্পোরেশন পুরসভা ইত্যাদি যেখানে এক একটি কাউন্টারে মানুষের দীর্ঘ লাইন পড়ে। সেই সকল দপ্তরে অধিকসংখ্যক কর্মী নিয়োগ করে কাউন্টারের সংখ্যা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলে, কোন কাউন্টারেই মানুষকে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। ব্যাবসা বাণিজ্য দোকান বাজার যতটা সম্ভব বেশী সময়ের জন্য খোলা রাখা দরকার ছিল। তাহলে কোথাও এক সময়ে অত্যাধিক ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো না। ফলে কল কারখানা অফিস দেকান বাজার ব্যাবসা বাণিজ্য এবং গণ পরিবহন চালু রেখেও এই ভাবে লকডাউন না করেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। কিন্তু না। কোন সরকারই সেই পথে না গিয়ে সবচেয়ে ফাঁকিবাজির পথটাই গ্রহণ করলো। তাতে না বাঁচলো মানুষের প্রাণ। না বাঁচছে মানুষের জীবন জীবিকা। মানুষ এখন এক চক্রব্যূহে একা।
২৫শে জুন’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত